কেন সৌদি যুবরাজের ঘনিষ্ঠ হতে উদগ্রীব তুরুস্কের এরদোয়ান ?



কেন সৌদি যুবরাজের :   ঘনিষ্ঠ হতে উদগ্রীব তুরুস্কের এরদোয়ান ?







২০১৮ সালে ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেট ভবনে সাংবাদিক জামাল খাসোগজির হত্যাকাণ্ডের পর ক্ষুব্ধ তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান খোলাখুলি আঙ্গুল তুলেছিলেন যুবরাজ মোহামেদ সালমানের দিকে। 


তারপর খুব দ্রুত মুসলিম বিশ্বের দুই প্রভাবশালী দেশের সম্পর্কে ধস নামতে শুরু করে। বছর খানেকের মধ্যে সম্পর্ক এতটাই তলানিতে গিয়ে ঠেকে যে সৌদি আরব আনুষ্ঠানিকভাবে তুরস্কের পণ্যের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। 

অন্যদিকে ,বহুদিন পর্যন্ত সুযোগ পেলেই রাজ পরিবারকে একহাত নিতে ছাড়েননি মি. এরদোয়ান। দুই দেশের সরকার নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ায় নিয়মিত দুই সরকারের মধ্যে প্রকাশ্যে কাদা ছোঁড়াছুড়ি চলেছে অনেকদিন।




কেন সৌদি যুবরাজের :   ঘনিষ্ঠ হতে উদগ্রীব তুরুস্কের এরদোয়ান ?





কিন্তু এপ্রিলে হঠাৎ মি. এরদোয়ান সৌদি আরব সফর এবং জেদ্দায় যুবরাজ সালমানের সাথে টাট্রা করমর্দনের ছবি প্রকাশ হওয়ার পর ইঙ্গিত মেলে হাওয়া বদলাতে শুরু করেছে। 

গত কয়েকমাসে দুই দেশের সম্পর্কের উষ্ণতা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ব্যবসা, বিমান চলাচলে বিধি নিষেধ উঠেব গেছে। সৌদি আরবে তুর্কি টিভি সিরিজ এর সম্প্রচার শুরু হয়েছে। দু দেশের মিডিয়ার পরস্পরের বিরুদ্ধে যে প্রচারণা চলছিল তা বন্ধ হয়েছে।


এরপর বুধবার মি. এরদোয়ান এর বিশেষ আমন্ত্রণে যুবরাজ সালমান তুরস্কে যাওয়ার পর  এটি এখন পরিষ্কার যে আঙ্কারা এবং রিয়াদের সম্পর্কে জমাট বরফ গলছে।




কেন সৌদি যুবরাজের :   ঘনিষ্ঠ হতে উদগ্রীব তুরুস্কের এরদোয়ান ?








কেন হাত বাড়ালেন এরদোয়ান ?




আন্তর্জাতিক রাজনীতি পর্যবেক্ষকদের মধ্যে কোনো সন্দেহ নেই যে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানই  সৌদি আরবের সাথে নতুন করে  সুসম্পর্ক তৈরিতে উদগ্রীব হয়ে পড়েছেন। 

''আমি বলবো মি. এরদোয়ান কিছুটা হলেও নতজানু হয়েছেন। গত কয়েক মাস ধরে বিশেষ করে সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে চটে যাওয়া সম্পর্ক পুনরুদ্ধারে তিনি উঠে-পরে লেগেছেন,''বলেন লন্ডনে মধ্যপ্রাচ্যের ভূ -রাজনৈতিক ঝুঁকি সম্পর্কিত গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারেস্টের প্রধান সাদি হামদি। 







কিন্তু কেন মি. এরদোয়ান তার চিরাচরিত যুদ্ধংদেহী ভাবমূর্তি আড়ালে রেখে নতজানু  হচ্ছেন?


সাদি হামদি মনে করেন,প্রথম এবং প্রধান  কারণ তুরস্কের অর্থনৈতিক সংকট। 

তুরস্কের মুদ্রা লিরা এরকম মুখ থুবড়ে পড়েছে। রয়টার্স বার্তা সংস্থার খবর অনুযায়ী ২০২১ সালে এক বছরেই ডলারের বিপরীতে লিরার মূল্যমান অর্ধেক হয়ে গেছে। মুদ্রাস্ফীতির হার ৭০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। 

''নির্বাচনের মাত্র একবছর বাকি। নির্বাচনের আগে উপসাগর থেকে বিশেষ করে সৌদি আরব থেকে বিনিয়োগ  ফিরিয়ে এনে  অর্থনৈতিক সংকট কিছুটা হলেও সামাল দেয়ার চেষ্টা করছেন মি.এরদোয়ান,''বলেন মি. হামদি। 







গত সপ্তাহে মি. এরদোয়ান বলেন ,তিনি এবং সৌদি যুবরাজ ''দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে কতোটা উচ্চতায় নেয়া সম্ভব তা নিয়ে কথা বলবেন। 

তার সরকারের একজন কর্মকর্তা সাংবাদিকদের বলেন , সৌদি যুবরাজের সফরের ফলে দুই দেশের মধ্যে ''সংকট পূর্বকালীন সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে এবং সম্পর্ক পুরোপুরি স্বাভাবিক হবে। ''

জানা গেছে , জ্বালানি ,ব্যবসা এবং নিরাপত্তা বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি হবে। সেই সাথে ,তুর্কি স্টক মার্কেট এ সৌদি বিনিয়োগ নিয়ে কথা হবে। সৌদি আরবের কাছে তুরস্কের তৈরী সামরিক ড্রোন বিক্রি নিয়ে কথা হবে। 


অর্থাৎ ২০২৩ সালের জুনের নির্বাচনের আগে তুরস্কের অর্থনীতির দুরবস্থা কাটাতে মি. এরদোয়ান সৌদিদের কাছ থেকে ব্যবসা এবং বিনিয়োগ চাইছেন। 








পিছু হটছেন এরদোয়ান ?


যুক্তরাষ্টের গবেষণা প্রতিষ্ঠান কাউন্সিল অব ফরেন রিলেশন্সের গত মাসে প্রকাশিত একটি প্রকাশনায় গবেষক স্টিভেন এ কুক লিখেছেন - মি. এরদোয়ান তার 'স্বভাবসুলভ আগ্রাসি' পররাষ্ট্রনীতি থেকে হয়তো পিছু হটছেন। 

''তার অনর্থক আগ্রাসি পররাষ্ট্র নীতির কারণে মধ্যপ্রাচ্যে ,বিশেষ করে ধনী উপসাগরীয় আরব দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক নষ্ট করে ফেলেছিলেন তিনি। তাতে তুরস্কের কোনো লাভ হয়নি,''বলেছেন মি.কুক। 









২০১৩ সালে মিশরে মুসলিম ব্রাদারহুড সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখলের পর প্রেসিডেন্ট সিসির ওপর প্রচণ্ড খেপে যান মি. এরদোয়ান। তখন থেকেই মিশরের বিরোধী রাজনৈতিকদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছেন তিনি। ইস্তাম্বুলে বসে তিনি সিসি সরকারের বিরুদ্ধে তৎপরতা চালাতে দিয়েছেন। 

সৌদি আরব মিশরের ঐ  সামরিক অভ্যুত্থান সমর্থন করলে সৌদি  রাজপরিবারের ওপর ক্ষেপে যান মি. এরদোয়ান। 

ফলে,২০১৭ সালে সৌদি আরব ,ইউএই সহ চারটি উপসাগরীয় দেশ কাতারের উপর  কাতার এর সমর্থনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তুরস্ক। 









এরপর ২০১৮  সাল খাসোগজি হত্যাকাণ্ডের পর সৌদি আরব এবং ইউএই কে একহাত এ নেয়ার   সবরকম চেষ্টা  করেন মি. এরদোয়ান। 

অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন ,খাসোগজি হত্যাকাণ্ডের বিচারের চেয়ে মি. এরদোয়ানের প্রধান লক্ষ্য ছিল ঐ ঘটনাকে কাজে লাগিয়ে সৌদি আরবকে ঘায়েল করা। 

ফলে,ক্রমশ চটে যেতে থাকে সৌদি আরব,ইউএই এবং মিশরের মতো মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী দেশগুলোর সাথে তুরস্কের অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক। 

সম্পর্কে চিড় ধরার আগে সৌদিরা ছিল তুরস্কে স্থাবর সম্পত্তির  সবচেয়ে বড় ক্রেতা। একশোরও বেশি  তুর্কি কোম্পানি সৌদি আরবে ব্যবসা করেছিল। এক লাখের মতো তুর্কি নাগরিক সৌদি আরবে কাজ করে। 

সৌদি  অর্থনৈতিক বিশ্লেষক আমাল আব্দুল-আজিজ-আল-হাজানীর দেয়া হিসাব মতে তুরস্ক ২০২৩ সালের মধ্যে ২,৫০০ কোটি মার্কিন ডলার এর সৌদি বিনিয়োগ টার্গেট করেছিল, আর দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য  ২,০০০ কোটি ডলারে  যেতে চেয়েছিল। সেসব টার্গেট ভেস্তে যায়। 


আরো পড়ুন :






'বন্ধু কমছে ,শত্রু বাড়ছে '

সাদি হামদি বলেন ,তুরস্কের ভোটারদের কাছে পররাষ্ট্রনীতির চেয়ে অভ্যন্তরীন অর্থনীতির গুরুত্ব অনেক বেশি। ''অনেক মানুষের ভেতর এমন ধারণা শক্ত হচ্ছে যে মি. এরদোয়ান এর কারণে তুরস্কের বন্ধু কমছে , শত্রু বাড়ছে। ''

সম্প্রতি একটি ভিডিও ফুটেজ তুরস্কেরর সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে যায় যেখানে দেখা যায় ব্যাবসায়ীদের এক সম্মেলনে এক নারী উদ্যোক্তা দাঁড়িয়ে চিৎকার করে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানকে বলছেন সৌদি আরবের সাথে সম্পর্ক চটে যাওয়ায় তার ব্যবসা লাটে ওঠার পথে। 






শুধু অর্থনীতিই নয়,ভূ-রাজনীতিতে তুরস্ককে পাল্টা ঘায়েল করতে এবং ইউএই তৎপরতা শুরু করেছিল।

পূর্ব ভূমধ্যসাগরে মজুদ জ্বালানির মালিকানা নিয়ে তুরস্কের সাথে বিরোধে সাইপ্রাস ও গ্রিসের সমর্থনে এগিয়ে আসে মিশর,সৌদি আরব এবং ইউএই। 

২০২০ সালে গ্রীষ্মে গ্রিসের বিমান বাহিনীর এক মহড়ায় অংশ নেয় সৌদি এবং আমিরাত বিমান বাহিনীর পাইলটরা। 






এসব ঘটনা তুরস্ক কে উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল।

স্টিভেন এ কুক তার বিশ্লেষণে বলেন ,''এরদোয়ান সরকার এখন উপলব্ধি করছে যে আঞ্চলিক দেশগুলোর উপর তার ইচ্ছা চাপিয়ে দেয়ার মতো শক্তি তাদের নেই। ''

আর এসব প্রেক্ষাপটেই দৃশ্যত উল্টো পথে হাটতে শুরু করেছেন মি. এর্দোয়ান। 







যেসব ছাড় দিয়েছে তুরস্ক 


সম্প্রতি খাসোগজির বিচার প্রক্রিয়া বন্ধের  ঘোষণা দিয়েছেন । 

মিশরের বিরোধী বেশ কিছু রাজনৈতিক ইস্তাম্বুলে বসে প্রেসিডেন্ট সিসির সরকারের বিরুদ্ধে যে তৎপরতা চালাচ্ছিল তা প্রায় বন্ধ করে দেয়া  হয়েছে। তাদের পরিচালিত অনেক টিভি চ্যানেল এ তালা ঝোলানো হয়েছে। মিশরীয় সরকার বিরোধীদের পরিচালিত বেশ কিছু সোশ্যাল মিডিয়া সাইট ও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তাদের অনেককে তুরস্ক ছাড়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। 







তাহলে মি. এরদোয়ান পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে অনুসূচনা করছেন ?স্বীকার করছেন ?

সাদি হামদি মনে করেন ভুল স্বীকার না করলেও মি. এরদোয়ান মেনে নিচ্ছেন যে তিনি যেমনটা চেয়েছিলেন তেমনটা হয়নি।

মি হামদির মতে -নির্বাচনের আগে তিনি তুরস্কের মানুষকে দেখাতে চাইছেন যে অভ্যন্তরীন বিষয়গুলোকে তিনি গুরুত্ব দিচ্ছেন।তবে তিনি মনে করেন না যে মি. এরদোয়ান তার বিদেশ নীতি  বর্জন করছেন ,বড়জোর ''স্বল্পমেয়াদে অগ্রাধিকার বদলাচ্ছেন। ''







সৌদি আরবের দিকে হাত বাড়িয়ে এরদোয়ানের শক্তিশালী ভাবমূর্তি চট খেয়েছে সন্দেহ নেই ,কিন্তু একইসাথে এটাও সত্যি যে তুরস্ক এখনও সদম্ভে লিবিয়ায় রয়েছে। মধ্য এশিয়ায় প্রভাব বাড়াচ্ছে। ভূমধ্যসাগরে তুরস্ক এখনও অনেক বড় শক্তি। সিরিয়া থেকে তারা নড়বে বলে মনে হয় না। এমন কি সব-সাহারা অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের পথ থেকে সরে যাবার কোনো লক্ষণ তারা দেখাচ্ছে না। 

মি. হামদি মনে করেন ,সম্ভবত সৌদি আরব এবং ইউএই বা মিশরের নেতারাও মি. এরদোয়ানের মনোভাব সম্পর্কে এখন সন্দিহান। 








''প্রথম যখন এরদোয়ান সৌদি এবং আমিরাতের কাছে যান,তারা  উৎসাহ দেখায় নি। তাদের আস্থা অর্জন করতে গত  কয়েকমাস অনেক ছাড় দিয়েছেন এরদোয়ান। তারপরও মিশর এখনো তার ব্যাপারে শীতল। ''

মি. হামদি বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের অনেক বিশ্লেষক বলছেন এবং লিখছেন যে বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট ঘুচলে এবং নির্বাচন পেরুলে মি. এরদোয়ান পুরোনো রূপ  করবেন। 







কেন সাড়া দিচ্ছে সৌদি আরব 




এমন সন্দেহ থাকা সত্ত্বেও সৌদি আরব বা ইউএই কেন সাড়া দিচ্ছে?

প্রথম কথা, খাসোগজি হত্যাকাণ্ডের পর গোত্তা খাওয়া ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে মরিয়া হয়ে উঠেছেন সালমান। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান তাকে খানিকটা হলেও সুযোগ করে দিয়েছেন। 

তবে একই সাথে সাদি হামদি মনে করেন ,বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটে সস্তায় তুরস্কের সম্পদে অংশীদার হওয়ার সুযোগ তুরুস্ক ছাড়তে চাইছে না। 





তাছাড়াও বলেলন ,তুরস্কের সমাজ ও রাজনীতির অন্যান্য অংশের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের সুযোগ পেয়েছেন সৌদি আরব এবং আমিরাত।

''মোহাম্মদ সালমান এবং মোহামেদ বিন জায়েদ হয়তো মনে করেছেন এর্দোয়ান দীর্ঘদিন থাকবেন না এবং তুরস্কের বিরোধীদের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের এটাই সুযোগ। ''



আরো পড়ুন :














Post a Comment