গ্রিস ও ট্রয়ের উপাখ্যান  




গ্রিস ও ট্রয়ের উপাখ্যান : ট্রয় নগরী পর্ব ১













ট্রয় নগরী  





অনেক কাল আগে, এশিয়া মাইনরের উত্তরে, সমুদ্র উপকূল থেকে একটু দূরে, ট্রয় নামে এক নগরী অবস্থিত ছিল। সেখানেই গ্রিকদের সঙ্গে ট্রয়িদের প্রচন্ড যুদ্ধ হয়েছিল। 






একিলিস, হেক্টর এবং আরো অনেক বড় বড় বীর সেই যুদ্ধে প্রাণ দিয়ে চিরদিনের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন। তাদের দেবতারাও কেও কেও ট্রয়িদের পক্ষে, আবার অনেকেই গ্রিকদের পক্ষে সেই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। প্রায় দশ বছর ধরে সেই যুদ্ধ চলে। 






ট্রয়ের দুই নদী- স্কামান্দার আর সিময়েস, রক্তে লাল হয়ে উঠেছিল। সেই যুদ্ধে ট্রয় নগরী ধ্বংস হয়ে যায়, আর গ্রিকদের মধ্যে যারা যুদ্ধে মরেনি তাদের অনেক ঘরে ফেরার পথে মারা যায়, আবার কেও কেও বহু বছর ধরে ঝোড়ো সমুদ্রের বিপজ্জনক উপকূলে উপকূলে ঘুরে ঘুরে কাটায় এবং ঘরে ফিরে  এসে  দেখতে পায়, সেখানেও তাদের জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে হত্যাকান্ড আর ষড়যন্ত্র। 




শোনা যায়, এক নদীর জন্যই ট্রয়ের এই ভয়ানক মহাযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। এই নারী হচ্ছে মেনেলাউসের স্ত্রী হেলেন। এ ছাড়া দেবতাদের মধ্যেকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং মনীশের নির্বুদ্বিতা আর উচ্চাকাঙ্ক্ষাও ছিল তার অন্যন্য কারণ। 










ট্রয় নগরীর বিশাল প্রাচীর তৈরি করেছিলেন দেবতারা। দেবতাদের রাজা জিউস একবার অ্যাপোলোকে স্বর্গ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। মর্তে এসে অ্যাপোলো অনেক কিছু করেছিলেন, কিন্তু আমাদের এ কাহিনীর জন্য যতটুকু জানা দরকার তা হলো সমুদ্রের দেবতা পসিডনের সঙ্গে মিলে তিনি ট্রয়ের রাজা লাওমেডনের জন্য ট্রয়ের প্রাচীর তৈরি করে দিয়েছিলেন। 





এই বিশ্বাসঘাতক ও অকৃতজ্ঞ লাওমেডন প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, প্রাচীর তৈরি করা হলে তিনি তাদের পুরস্কৃত করবেন, কিন্তু কাজ যখন শেষ হয়ে গেল তখন তিনি তার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করলেন না।




 তখন অ্যাপোলো ত্রুদ্ধ হয়ে লাওমেডনের অধিবাসীদের মধ্যে মড়ক বিস্তার করে দিলেন। আর  পসিডন পাঠালেন সুমুদ্র থেকে এক দৈত্য, সেও দৈত্য সমস্ত শস্য ধ্বংস করে দিল এবং তার বিরুদ্ধে যেসব সৈন্য পাঠানো হয়েছিল তাদেরও সে শেষ করে দিল। 






প্রজাদের দুঃখ দেখে লাওমেডন মন্দিরে গেলেন। সেখান থেকে দৈববাণী হল যে, প্রতি বছর ট্রয়ের একজন করে কুমারী মেয়েকে ঐ দৈত্যর কাছে উৎসর্গ করতে হবে, তবেই দেবতাদের রাগ পড়বে।







  তাই প্রত্যেক বছর লটারি করে একজন কুমারীকে ঠিক করা হত। তারপর সেই কুমারী মেয়েটিকে ও তার বাপ-মা, বন্ধুবান্ধ যতই কাদাকাটি করুক, তাকে জোর করে সুমুদ্রের ধরে রেখে আসা হত, আর সুমুদ্র থেকে সেই বিশাল দৈত্য এসে তাকে খেয়ে ফেলত। 










রাজা বিশ্বাসঘাতকতার খেসারতস্বরূপ পাঁচ বছর ধরে এভাবে একজন করে কুমারী মেয়েকে উৎসর্গ করা হল। ষষ্ঠ বছরে সেই লটারিতে নাম উঠলো স্বয়ং রাজার মেয়ে হেসিওনির, তাকেই এখন এখন দৈত্যর কাছে দিয়ে আস্তে হয়!


আরো পড়ুন :












 তখন রাজা লাওমেডন আর তার রানী ভাবতে থাকেন দেবতাদের প্রতি আরো শ্রদ্ধাশীল হলে এবং নিজেদের প্রতিজ্ঞা করলেই ভালো হতো। তবুও দেবতারা দয়াপরবশ হলেন এবং তাদের বিপদের দিনে সাহায্য করার লোক এসে উপস্থিত হল। মহাবীর হেরাক্লিস সেই সময় আমাজনদের রানীর বিরুদ্ধে তার অভিযান শেষ করে সঙ্গীদের নিয়ে ফিরে আসছিলো। 





জাহাজ ট্রয়ে এসে পৌঁছাতেই হেরাক্লিস দেখতে পেল সমুদ্রের তীরে এক বিরাট মিছিল কাঁদতে কাঁদতে হেসিওনিকে উৎসর্গ করতে নিয়ে যাচ্ছে। হেরাক্লিস এই শোকের কারণ জানতে চাইলে রাজা লাওমেডন তাকে সব কথা খুলে বললেন। তাই শুনে হেরাক্লিস সেই দৈত্যর সঙ্গে যুদ্ধ করতে সম্মত হল। 



তবে শর্ত থাকলো যে, সে যদি যুদ্ধে জয়ী হয় তা হলে রাজা তাকে কয়েকটি ভালো ঘোড়া দেবেন। রাজার এই ঘোড়াগুলো হওয়ার বেগে ছুটতে পারত। রাজা খুশি হয়ে এই শর্তে রাজি হলেন আর হেরাক্লিস তার সিংহচর্মের জামাতা খুলে রেখে, শক্ত হাতে মুগুর হাতে নিয়ে যুদ্ধের জন্য তৈরি হলেন। 









একটু পরেই তীর থেকে অনেক দূরে দেখা গেল সমুদ্রের নীল জলকে ঘুলিয়ে সাদা করে সেই দৈত্যটা এগিয়ে আসছে, ঢেউয়ের মাথার উপর দিয়ে তার বিরাট মাথা দেখা যাচ্ছে, আর তার বড় বড় দাঁতের ফাক দিয়ে ফেনা গড়িয়ে পড়ছে। 






হেরাক্লিস নির্ভিকভাবে এগিয়ে গিয়ে মুগুরের এক আঘাতে দৈত্যকে অচেতন করে ফেলল, তারপর তরবারি বের করে দৈত্যটার হৃৎপিণ্ডের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতেই রক্তে সমুদ্রের জল লাল হয়ে গেল। 










হেসিওনি রক্ষা পেয়ে গেল। সকলেই ভাবলো মেয়ের প্রাণ রক্ষার কৃতজ্ঞতায় এবং পূর্বেকার বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তির কথা ভেবে আবার বীর হেরাক্লিসকে রাজা লাওমেডন সহজেই তার প্রতিশ্রুতি পুরস্কার দেবেন। কিন্তু না, কিছু লোক আছে যারা তাদের অভিজ্ঞতা থেকে কিছুই শিখতে পারে না। 






রাজা লাওমেডন আবার তার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলেন। হেরাক্লিস তখন তার সঙ্গীদের নিয়ে যুদ্ধ করে ট্রয় দখল করে ফেলল এবং রাজা লাওমেদনকে হত্যা করে তার পরিবারের সবাইকে বন্দি করল, তারপর তার অনুচর টেলামনের সঙ্গে সে হেসিয়নের বিয়ে দিয়ে দিল। পরবর্তীকালে তাদের ছেলে টিউকার গ্রিকদের সঙ্গে এসে ট্রয়ের মহাযুদ্ধে তার মায়ের দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল।





 রাজা লাওমেডন এর অন্যন্য বংশধরের মধ্যে শুধু একজনকে বাঁচতে দেওয়া হয়েছিল। সে হল রাজা বালকপুত্র প্রায়াম। এই প্রায়ামই পরবর্তীকালে ট্রয়ের শেষ ও শ্রেষ্ঠ রাজা হয়েছিলেন। ট্রয় ছেড়ে যাওয়ার আগে, মুক্তিপনের বিনিময়ে হেরাক্লিস এই প্রায়ামের তার পিতার সিংহাসনে বসিয়ে দিয়ে যায়। 












তারপর অনেক বছর ধরে, রাজা প্রায়াম ও তার রানী হেকুবার রাজত্বকালে ট্রয় ক্রমশ আরো সম্পদশালী ও শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকে। প্রায়াম তার পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর রাজাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করলেন, আরো বিশাল ও সুদৃঢ় দুর্গ নির্মাণ করলেন এবং ট্রয়ের পাশ দিয়ে কোনো জাহাজ গেলে তা থেকে কর আদায়ের ব্যবস্থা করলেন। তার রাজ্য পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী রাজ্যে পরিণত হল। 











রাজা প্রায়াম ও রানী হেকুবার উনিশটি ছেলেমেয়ে ছিল। তাদের মধ্যে হেক্টর ছিল বিখ্যাত। শক্তিতে এবং যুদ্ধের কৌশল, কিংবা মনের উদারতায় ও বন্ধুদের প্রতি আনুগত্য তার মত আর কেও ছিল না।





 এসব গুনের দিক থেকে প্রায়াম এর ভ্রাতুষ্পুত্র ইনিয়াস ছাড়া আর কেও তার সমকক্ষ ছিল না। ইনিয়াস ছিল প্রেমের দেবী আফ্রোদিতির ছেলে। এই বীর ইনিয়াস দীর্ঘকাল পরে, বহু অভিযান শেষে, রোমান জাতির প্রতিষ্ঠা করেন।















যে দেশে এই রকম বীরযোদ্ধা রয়েছে, এতগুলো মিত্রদেশ রয়েছে, এত যার ঐশ্বর্য ও সম্পদ, সেই ট্রয় নগরী শক্তিতে ও সুখে আইডা পর্বতের পাদদেশ, সিময়েস ও স্কামান্দার নদীবিধৌত হয়ে, বিশাল স্তম্ভ ও প্রাচীরে পরিবেষ্টিত হয়ে চিরকাল গৌরবভরে বিরাজ করবে এই রকম ধারণা হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু দেবতাদের ইচ্ছা সেরকম ছিল না। 

আরো পড়ুন :






















Post a Comment