আবার বাংলা সালতানাত আমল (১৪১৮-১৪৩৫/৩৬ সাল )



বাংলা সালতানাত : বাংলার প্রথম আমির এবং প্রথম খলিফা











                         সুলতান জালাল-উদ-দীন মুহম্মদ শাহ (১৪১৮-১৪৩৩ সাল)





সুলতান ইবরাহীম শর্কীর বাংলা আক্রমণের সময় রাজা গণেশ তার ১২ বছর বয়স্ক পুত্র যদুকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হতে দিয়ে সিংহাসন ছেড়ে শোর দাঁড়ান। প্রায় দুই বছর যদু ছিলেন সিংহাসনে আসীন। তারপর তাকে সরিয়ে আবার রাজা গণেশের সিংহাসনারোহন এবং প্রায় ১৪ মাস পর মৃত্যুবরণ করে। অতঃপর মাস দুয়েক মহেন্দ্রদেবের রাজত্বকাল এবং তারপর আবার যদুর মনসদ লাভ। 















ঐতিহাসিকেরা সুলতান জালাল-উদ-দীন মুহম্মদ শাহকে সুশাসকরূপে প্রশংসা করেছেন। পাণ্ডুয়া থেকে গৌড়ে তিনি রাজধানী স্থানান্তর করেন। দ্বিতীয় বার মনসদে বসেই তিনি যেসব ব্রাক্ষণ পন্ডিত তাকে অর্থের লোভে শুদ্ধির বিধান দিয়েছিলেন, আর্থিকভাবে তাদের শাস্তি বিধান করেন। 






প্রশাসনে তিনি দলাদলির ঊর্ধ্বে থেকে সুশাসনের ব্যবস্থা করেন। এর আগে রাজা গণেশ শেখ নূর কুতব-ই-আলমের পুত্র পৌত্রদিগকে সোনারগাঁওয়-এ নির্বাসিত করেছিলেন। হত্যা করেছিলেন পুত্র শেখ আনোয়ারকে। কিন্তু সুলতান জালাল-উদ-দীন নূর কুতব-ই-আলমের পৌত্র শেখ জাহিদকে আবার সসম্মানে রাজধানীতে ফিরিয়ে আনেন। ঐতিহাসিক ইবনে হজরের ভাষ্য অনুসারে, সুলতান জালাল-উদ-দীন একজন নিষ্ঠাবান মুসলমান হিসেবে রাজ্য শাসন করেন, ইসলামের প্রতিষ্ঠাকল্পে নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। 





তার পিতা কর্তৃক ধ্বংসকৃত মসজিদ,মাদ্রাসা পুননির্মাণ করেন এবং ইমাম আবু হানিফার মতবাদ গ্রহণ করেন। তার আগে বাংলার সুলতানেরা মুদ্রায় কালেমা খুদাই করতেন না। সুলতান জালাল উদ-দিন মুদ্রায় কালেমা খোদাই করার রীতি চালু করেন।















নিষ্ঠাবান মুসলমানের জীবন যাপন করলেও সুলতান পরধর্মের প্রতি ছিলেন উদার। শাসক হিসাবে তিনি যোগ্যতার পরিচয় দেন, রাজ্য বিস্তার করে নিজ শৌর্যের পরিচয় দেন এবং চীন-সম্রাট ও মিশরের খলীফা প্রমুখের সঙ্গে দূত বিনিময়ের মাধ্যমে সৌহার্দ্য বজায় রাখেন।




 আরাকানের রাজাকে স্বীয় সিংহাসন পুনরুদ্ধারে সাহায্য করে তিনি মহানুভবতার পরিচয় দেন। আরাকানের ইতিহাসে সুলতান জালাল-উদ-দীন মুহম্মদ শাহর রাজত্বের একটি ঘটনা জানা যায়, যার থেকে প্রমাণিত হয় যে, তিনি ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার পর তাতে একনিষ্ঠ ছিলেন। ঘটনাটি হচ্ছে:







আরাকান দেশের এক রাজা ব্রহ্মরাজের নিকট রাজ্য হারিয়ে বাংলার সুলতানের শরণাপন্ন হন। বাংলার সুলতান তাকে সাহায্য করতে সম্মত হয়ে ওয়ালি খান নামক এক সেনাপতিকে বাহিনীসহ আরাকান-রাজের সঙ্গে প্রেরণ করেন। কিন্তু ওয়ালি খান বিশ্বাসঘাতকতা করে ব্রহ্মরাজের সঙ্গে যোগ দিয়ে আরাকানা রাজকে বন্দি করেন। আরাকান-রাজ্ কোনক্রমে  পালিয়ে এসে বাংলার সুলতানকে সব কিছু জানান। 





তখন সুলতান অন্য বিশ্বাসী এক সেনাপতির উপর আরাকান উদ্ধারের দায়িত্ব অর্পণ করেন। এইবার আরাকান-রাজ্ যুদ্ধে জয় লাভ করে নিজ রাজ্য উদ্ধার করেন। তবে সুখটানের এই উপকারের বিনিময়ে আরাকান-রাজাকে সুলতানের অনুগত্য স্বীকার করতে হয়। তখন থেকেই আরাকানের রাজাকে মুদ্রার উপরে ফার্সী অক্ষরে মুসলমানী নাম খোদাই করারপ্রথাও চালু হয়। 














যদু সেনের ইসলাম গ্রহণের কারণ যাই হোক না কেন ,ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর ইসলামে তার গভীর  নিষ্ঠারই প্রমান পাওয়া যায়। তার আগে প্রায় ২০০ বছর ধরে মুসলিম সুলতানেরা বা শাসনকর্তারা বাংলায় তাদের অধিকার প্রকাশ করে গেছেন। কিন্তু তাদের কেউই মুদ্রায় কালেমা খোদাই করতেন না। 




মুদ্রায় কালেমা খোদায় করার প্রথম কৃতিত্ব সুলতান জালাল-উদ-দীন মুহম্মদ শাহর। শুধু তাই নয়, অন্য এক ব্যাপারেও এই সুলতান নতুনত্ব দেখিয়েছেন। তার পূর্ববর্তী সুলতানেরা ডাকলেই বাগদাদের খলিফার আনুগত্য স্বীকার করতেন এবং কখনও তাদের মুদ্রায় বা শিলালিপিতে নিজেদেরকে খলিফার সহায়ক বলে অভিহিত করতেন। সুলতান জালাল-উদ-দীনও প্রথম দিকে তাই করেছেন। 




কিন্তু তার রাজ্যত্বর শেষ দিকের মুদ্রা বা শিলালিপিতে তিনি খলীফাতুল্লাহ উপাধি ধারণ করেছেন অর্থাৎ নিজেকে আল্লাহর খলীফা বলে দাবি করেছেন। তার মৃত্যুর পর তার পুত্র আহমদ শাহ ব্যস কম বলে এই উপাধি ধারণ করেননি, কিন্তু আহম্মদ শাহর পরবর্তী সুলতানদের মধ্যে অনেকেই এই উপাধি ধারণ করেছিলেন। 













সমসাময়িক আরবি গ্রন্থাকার ইব্ন হজরের (১৩৭২-১৪৪৯ খৃ.) লেখা ইনবাউল গুমর থেকে জানা যায় যে, সুলতান জালাল-উদ-দীন মুহম্মদ শাহ ইসলামের উন্নতি সাধন করেন। ইসলামের উন্নতির জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। রাজা গণেশ কর্তৃক ধ্বংসকৃত মসজিদগুলোর পূর্ণনির্মান ও সংস্কার করেন এবং ইমাম আবু হানিফার মতবাদ গ্রহণ করেন। 






পবিত্র মক্কা মুয়াজ্জমায় তিনি অনেকগুলো ভবন, বিশেষ করে একটি সুন্দর মাদ্রাসা তৈরী করান। এ ব্যাপারে তিনি ছিলেন সুলতান গিয়াস-উদ-দীন আজম শাহর অনুসারী। ৮৩২ হিজড়ায় তিনি মক্কাবাসীদের দান করার জন্যও অনেক অর্থ পাঠিয়েছিলেন। পরে মিশরের খলিফার কাছে উপহার প্রেরণ করেন এবং নিজের স্বকৃতির জন্য মিশরের খলিফার অনুমোদন প্রাথনা করেন।




 মিশরের খলীফা এই স্বীকৃতি প্রদান করে বাংলার সুলতান সন্মান পরিচ্ছদ পাঠান। ইটা ঘটেছিল সুলতান জালাল-উদ-দীন মুহম্মদ শাহর খলীফাতুল্লাহ উপাধি গ্রহণের আগের বছর। তাতে অনুমতি হয় মিশরের খলীফার অনুমোদন লাভের পরেই তিনি খলীফাতুল্লাহ উপাধি গ্রহণ করেছিলেন। 












এ প্রসঙ্গে ডক্টর এম.এ. গফুরের আলোচনায় (J A S P, VII1. No.1, 1963, P. 62, 65) উল্লেখযোগ্য। তার কিছু উদ্ধৃতাংশের বাংলা অনুবাদ নিচে দেওয়া হলো:- 







জালালুদ্দিন কি খলিফার কাছে স্বীকৃতি বিনিয়োগ চেয়েছিলেন? রাজ্যে নিজের অবস্থাকে সুদৃঢ় করার জন্য তা চাইতে তিনি পারতেন। কিন্তু তা চাইলে ও পেলে তিনি নিজের মুদ্রায় খলীফার নাম উৎকীর্ণ করে বিষয়টি প্রচার করতেন। কিন্তু জালাউদ্দিন মুহম্মদ শাহের কোন মুদ্রায় খলীফার নাম কোন দিনই উৎকীর্ণ করা হয়নি।




 ওপর দিকে তার মুদ্রা ও শিলালিপিতে তিনি নিজেই খলীফা উপাধি ধারণ করেন। আশ্চর্যের বিষয়, আব্বাসী খলীফার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পরেই জালাউদ্দিন মুহম্মদ খলীফা উপাধি গ্রহণ করেন। প্রথম জালালুদ্দিনের মুদ্রায় খলীফা উপাধি দেখা যায় ৮৩৪ হিজরায়। ইবন হজর আসকালানী খুব স্পষ্টভাবে বলরছেন যে, ৮৩৩ হিজরায় সুলতান জালালুদ্দীনের কাছে আব্বাসী খলীফার দূত আসে। 






আল-সাখাওয়ি লিখেছেন, তিনি (জালালুদ্দিন) খলীফার কাছে আহ্দ চান। খলীফা তা দেন-একজন সম্ভ্রান্ত লোক মারফত সন্মান পরিচয় পাঠিয়ে। আহদ মানে বিভূষণ নয়, খলীফার সঙ্গে কোন সম্প্রদায়ের চুক্তি যে তারা বিশ্বস্ততভাবে নিজেদের কর্তব্য পালনের বিনিময়ে বাধ্যতামূলক একটি প্রতিশ্রুতি লাব করবে। বিভূষণ উৎসের পরে এই চুক্তি করা হয়।   










ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বাগদাদের পতনের পরে খলীফার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সাধিত হয়। চতুর্দশ শতাব্দীর তিনজন সুন্নী আইনবিদ বদরুদ্দীন ইবনে জমা,ইবন তয়মিয়া এবং ইবন খালদুনের লেখা থেকে তা বোঝা যায়। 




চতুর্দশ শতাব্দীতে পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতির ফলে খলীফা নিয়মতান্ত্রিক প্রধান পর্যবসিত হন। তার সব ক্ষমতা শাসক সুলতানের হাতে চলে যায়। একে আইনসংগত রূপ দেওয়ার জন্য ইবন জমা খলীফার সব ক্ষমতা শাসকের কাছে হস্তান্তরিত করার বিধান লিপিবদ্ধ করেন।  







এই বিধান অনুসারে যার কাছে ক্ষমতা স্থান্তারিত হয় , তিনি আব্বাসী খলিফা হিসেবে পূর্ণ কতৃত্ব প্রয়োগ করতে পারতেন অর্থাৎ বিচারক  শাসনকর্তা নিয়োগ করতে এবং সৈন্যবাহিনী ও কোষাগারের অধ্যাক্ষ হতে পারতেন। ইব্ন জমা লিখেছেন যে দূরে দূরে ছড়ানো ইসলামী রাজ্যগুলিকে একসূত্রে আবদ্ধ করার জন্য এ রকম করা দরকার হয়ে পড়েছিল। খলিফা নির্বাচনে এই প্রক্রিয়াকেই অহদ বলা হতো। 










আমরা এখন যুক্তিসঙ্গতভাবে ধরে নিতে পারি যে ,সুলতান জালালুদ্দীন মুহম্মদ শাহ আশরাফ বারসবায়ের মারফৎ মিশরের খলিফার কাছে তার প্রতি খলিফার অধিকার হস্তান্তর চেয়েছিলেন।তার প্রতিদ্বন্দ্বী জৌনপুরের সুলতান মুদ্রায় মিশরের আব্বাসী খলীফার নাম খোদাই করতেন। বাংলার সুলতান এখন তার উপর টেক্কা মারলেন।তিনি এখন নিজেকে 'খলিফৎ আমীর আল-মুমিনীন' না বলে সোজাসুজি 'খলিফৎ আল্লাহ' বলতে লাগলেন। 









এখানে উল্লেখ্য যে,সুলতান জালাল-উদ-দীন মুহম্মদ শাহর পরে 'খলীফাতুল্লাহ উপাধি ধারণকারী সুলতানের মধ্যে রয়েছেন নাসির-উদ-দীন মাহমুদ শাহ,রুকন-উদ-দীন বারবক শাহ,শামস উদ-দীন ইউসুফ শাহ ,জালাল-উদ-দীন ফতেহ শাহ এবং আল-উদ-দীন হোসেন শাহ। সুলতান নাসির উদ-দীন মাহমুদ শাহ এই উপাধি  ধারণ করেন মুদ্রা ও শিলালিপিতে,রুকন-উদ-দীন বাবারক শাহ কেবল মুদ্রায় এবং  অন্যরা সবাই শুধু শিলালিপিতে তা ধারণ করেন। 

আরো পড়ুন :










অবিশ্যি "জালাল-উদ-দীন  মুহম্মদ শাহ প্রথম নিজেকে 'খলিফৎ আল্লাহ' বলেছিলেন। কারণ তিনিই ছিলেন মিশরের খলিফা কর্তৃক নিযুক্ত মূল খলিফা,পরবর্তী বাংলার সুলতানরা জালালুদ্দিনকে দেওয়া মিশরের খলিফার দলিল অনুসারে খলিফা হয়েছিলেন। তাই তারা  স্পষ্টভাবে  নিজেদের 'দলিল ও প্রমান মতে আল্লাহর খলিফা' বলেছেন। ''








পররাষ্ট্রনীতিতে সুলতান জালাল-উদ-দীন মুহম্মদ শাহ খুবই দক্ষতা ও বিজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছিলেন।সুলতান গিয়াস উদ-দীন আজম শাহের অনুসরণে চীন সম্রাটের সঙ্গে দূত বিনিময় প্রভৃতি  কাজ থেকে তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয়  পাওয়া যায়। তাতে করে দেশের অভ্যন্তরে মুসলিম জনসাধারণ যেমন খুশি হয় ,তেমনি বহির্জগতের সমর্থনও তিনি লাভ করেন।





 "শাহরুখের নিকট দুটি পাঠাইয়া রাজনৈতিক বিজ্ঞতার পরিচয় দেন। ইহার ফলে সুলতান ইব্রাহিম শর্কীর সহিত দ্বন্দে তাহার হাত শক্তিশালী হয়। মিশরের খলিফার নিকট দূত প্রেরণ এবং মুদ্রায় এবং শিলালিপিতে উৎকীর্ণ তাহার উপাধি বিশ্লেষণে দেখা যায় যে,তিনি ইহার দ্বারা দ্বিবিধ ফল লাভ করেন।





 প্রথমত,মুসলিম জাহানে তাহার মর্যাদা বৃদ্ধি পায়  এবং ইবরাহীম শর্কীর সহিত দ্বন্দ্বে তিনি আইনের দিক দিয়া শক্তিশালী হন এবং দ্বিতীয়ত ,তাহার স্বরাজ্যেও তাহার মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশের তিনিই প্রথম আমীর এবং তিনিই প্রথম খলীফা। 









সবশেষে বলতে হয়,সুলতান-জালাল-উদ-দীন  মুহম্মদ শাহ ছিলেন একজন বিচক্ষণ শাসক। হিন্দু-মুসলমান  সকলের প্রতি তিনি সমভাবে ব্যবহার করতেন,নিষ্ঠাবান মুসলিম সুলতান রূপে জীবনযাপন করলেও হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রতিও তিনি ছিলেন সহৃদয়। 











Post a Comment