বাংলা সালতানাত : স্বাধীনতা প্রয়াস কাল পর্ব -২
তুর্কিস্থানের ইলবারী উপজাতির এক সর্দারের পুত্র বলবন মঙ্গোল আক্রমণকারীদের হাতে বন্দি হয়ে বাগদাদের বাজারে ক্রীতদাস রূপে বিক্রি হন। তার প্রভু বসরার খাজা জামাল উদ্দিন তাকে নিজ পুত্র রূপে লালন পালন করেন।পরে দিল্লিতে নীত হলে সুলতান ইলতুৎমিশ তাকে ক্রয় করেন। সেখানে বলবন নিজ প্রতিভা বলে দ্রুত উন্নতি লাভ করে সুলতানের বিখ্যাত চল্লিশ ক্রীতদাসের দলভুক্ত হন।
বাহরাম শাহ ও মাসুদ শাহ এর রাজত্বকালে তিনি রাজকীয় উচ্চ পদে নিযুক্ত ছিলেন। এবং জামাতা নাসির-উদ-দীন মাহমুদের রাজত্বকালে সুলতানের প্রধানমন্ত্রী ও সেনাপতি রূপে দীর্ঘ ২০ বছর রাজ্য পরিচালনা করেন। ১২৬৬ সালে সুলতান নাসির উদ্দিন মাহমুদের মৃত্যুর পর তিনি গিয়াস উদ্দিন বলবন উপাধি ধারণ করে দিল্লির মসনদে আরোহন করেন। বিশ বছরেরও কিছু বেশি কাল সুযোগ্য সুলতান রূপে রাজ্য শাসন করে ১২৮৭ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
এর আগেই বলা হয়েছে যে ,সুলতান গিয়াস উদ্দিন বলবনের মসনদ লাভের পরেই লাখনৌতিতেও আরম্ভ হয় ক্ষমতার পট -পরিবর্তন।
সুলতান রুকন-উদ-দীন কায়কাউস (১২৯১-১৩০১০ সাল)
সুলতান নাসির-উদ-দীন মাহমুদের কনিষ্ঠ পুত্র সুলতান রুকন-উদ-দীন কায়কাউস লাখনৌতির স্বাধীন শাসনকর্তারূপে লাখনৌতির মসনদে আরোহণ করেন। ওদিকে দিল্লীর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা খিলজীদের করায়ত্ত হওয়ার ফলে বহু বংশীয় তুর্কি বাংলায় চলে আসেন। এই সময় বহু অলি-দরবেশ বাংলায় এসে ইসলাম প্রচারে রত হন।
সুলতান কায়কাউস তার রাজ্যকে দুটি প্রদেশে বিভক্ত করেন। বিহার ও লখনৌতি। বিহার শাসনের জন্য তিনি শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন ইখতিয়ার-উদ-দীন ফিরোজ এতগিনকে এবং লখনৌতি প্রদেশের জন্য শাহাব-উফ-দীন জাফর খান বাহরাম ইতগিনকে। লখনৌতি প্রদেশ তখন উত্তরে দেবকোট থেকে দক্ষিণে সাতগাঁও প্রজন্ত বিস্তৃত ছিল। দশ বছর রাজত্ব করে সুলতান রুকন-উদ-দীন কায়কাউস পরলোক গমন করেন। তার মৃত্যু সম্পর্কে ইতিহাস নীরব। অনুমানের ওপর ভিত্তি করে শুধু এটুকু বলা যায় যে, হয় তিনি অপুত্রক অবস্থায় স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেন অথবা তাকে বলপূর্বক সরিয়ে দেয়া হয়।
সুলতান শামস-উদ-দীন ফিরোজ শাহ
১৩০০ বা ১৩০১ সাল থেকে ১৩৩৮ সাল পর্যন্ত সময়টা বাংলার ইতিহাসে খুবই গুরুপ্তপূর্ণ। এই সময়কালে বাংলার স্বাধীনতা প্রয়াসও সাফল্যের পথে এগিয়ে যায়। এই সময়কালের প্রধান পুরুষ সুলতান শামস-উদ-দিন ফিরোজ শাহ। ইনিই পূর্ববর্তী সুলতান রুকন-উদ-দীন কাউকাউসের রাজত্বকালে বিহার প্রদেশের শাসনকর্তা ইখতিয়ার-উদ-দীন ফিরোজ ইতগিন।
দিল্লির খিলজির সুলতানদের আমলে লখনৌতি স্বাধীনতার স্বাদ ভোগ করছিলো। কিন্তু দিল্লিতে তুঘলক বংশীয়রা রাজ্-ক্ষমতা দখল করার পর লখনৌতি আবার দিল্লির অধিকারে চলে যায়। তবে দিল্লিতে সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলকের রাজত্বকালে ১৩৩৮ সালে লখনৌতি আবার স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিনিত হয় এবং সুদীর্ঘ বছর ধরে এই স্বাধীনতা অম্লান থাকে।
সুলতান গিয়াস-উদ-দীন বলবন লাখনৌতির সুলতান মুগীস-উদ-দীন তুগরিলকে ধ্বংস করে দিল্লিতে ফায়ার যাওয়ার আগে তার কনিষ্ঠ পুত্র বুগরা খানকে যখন লাখনৌতির শাসনভার দিয়ে যান, তখন ফিরোজ নামক দুইজন উপদেষ্টাকে লাখনৌতিতে রেখে যান। তাদেরই একজন বিহারের শাসনকর্তা ইখতিয়ার-উদ-দীন ফিরোজ ইতগিন, আর এই ফিরোজ ইতগিনই পরবর্তীকালের সুলতান শামস-উদ-দীন ফিরোজ শাহ। দিল্লিতে তখন সুলতান জালাল-উদ-দীন ফিরোজ খিলজীকে হত্যা করে আল্লা-উদ-দীন খিলজি মসনদে সমাসীন।
মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির পরে সুলতান শামস-উদ-দীন ফিরোজ শাহর সময়ে বাংলায় মুসলিম রাজ্য সর্বাধিক বিস্তৃত লাভ করে। এর আগে সুলতান কায়কাউসের সময়ে বঙ্গ ও সাতগাঁও মুসলিম শাসনাধীন আসে। কিন্তু এই অন্তর্ভুক্তি সুসম্পন্ন হয়। আর সোনারগাঁ এ প্রতিষ্ঠিত হয় টাকশাল। তা ছাড়াও সুলতান ফিরোজ শাহের সময়েই ময়মনসিংহ ও সিলেট পর্যন্ত লাখনৌতির সীমানা বিস্তৃত হয়। প্রত্যন্ত এলাকাসূমুহ ছাড়া সমগ্র বাংলাই এসময়ে মুসলিম অধিকারে আসে বলে ধরে নেওয়া যায়।
সুলতান ফিরোজ শাহ এর আমলে মুসলিম রাজ্যের বিস্তৃতিই সম্পন্ন হয়নি শুধু ,সমগ্র বাংলায় তখন ইসলামের প্রচারও বৃদ্ধি পায়। সাতগাঁও ও সিলেট বিজয়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে দুইজন মহান দরবেশের নাম হযরত শাহ শফী-উদ -দীন ও হযরত শাহ জালাল। সুলতান শামস-উদ-দীন ফিরোজ শাহ এই ইসলাম প্রচার এর কাজে প্রত্যক্ষভাবে উৎসাহ দেন ও সাহায্য করেন। রাজধানি লাখনৌতির তুলনায় তখন পাণ্ডুয়া ছিল অধিকতর স্বাস্থকর স্থান এবং সামারিক ও যোগাযোগের দিক থেকে অধিকতর উপযোগী। তাই সুলতান ফিরোজ শাহ লাখনৌতি থেকে রাজধানী পান্ডুয়ায় স্থানান্তর করেন এবং তার নাম রাখেন ফিরোজাবাদ।
২৫.সুলতান গিয়াস-উদ-দীন বাহাদুর (১৩২২-১৩২৮ সাল )
সুলতান শামস-উদ-দীন শাহর রাজত্বের শেষদিক এবং তার মৃত্যুর পর সুলতান গিয়াস-উদ-দীন বাহাদুর এর রাজত্বকালের বিবরণী নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে যথেষ্ট মন্তব্য লক্ষ্য করা যায়। এইসব মন্তব্যের প্রধান কারণ হ্চ্ছে সুলতান শামস -উদ-দীন শাহর রাজত্বকালেই তার এবং পুত্রদের নামে মুদ্রার প্রচলন। এখানে উল্লেখ যে ,সুলতান শামস উদ্দিন ফিরোজ শাহের ছিলো সাত পুত্র এবং পরিণত বয়সে সুলতান বাংলার মসনদে আরোহন কালে তার ছেলেরাও ছিল বেশ বয়স্ক।
co
de
দেখা যায় ,সুলতান শামস উদ্দিন ফিরোজ শাহ এর রাজত্বকালেই তার তার পুত্র জালাল উদ্দিন মাহমুদ ,শিহাব উদ্দিন বুগদা ও গিয়াস উদ্দিন বাহাদুর লাখনৌতি টাকশাল থেকে নিজ নিজ নামে মুদ্রা প্রচলন করেছেন। তাতে করে কিছু কিছু ঐতিহাসিক মনে করেন যে ,সুলতান ফিরোজ এর বিরুদ্ধে তার পুত্রগণ বিদ্রোহ করেছিল। এ সম্পর্কে ডক্টর কানুনগোর মতামত ডক্টর আব্দুল করিম বলেন , ডক্টর কানুনগো ঠিকই বলিয়াছেন যে ,ফিরোজ শাহ বেশি বয়সে সিংহাসনে আরোহন করেন।ঐ সময়ে তাহার কয়েকজন বয়স্ক ছেলে ছিল।
সুলতান তাহার উপযুক্ত ছেলেদের এবং অন্যান উচ্চপদস্থ অফিসারদের সাহায্যে রাজ্যের সীমা বর্ধিত করেন। তাই মনে হয় সুলতান পুত্রদিগকে মুদ্রা প্রচলনের মতো রাজকীয় ক্ষমতা ব্যবহারের সুযোগ দেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করিলে বলিতে হয় যে ,ফিরোজ শাহ এর পুত্রগণ কর্তৃক মুদ্রা প্রচলন তাহাদের বিদ্রোহের ফল নয়,বরং পিত কর্তৃক পুত্রদের সঙ্গে ক্ষমতা ও অধিকার ভাগাভাগির ফল। পিত এবং পুত্রদের সমবেত প্রচেষ্টায় লাখনৌতির মুসলিম রাজ্য অধিকতর শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং চারিদিকে মুসলিম রাজ্যের বৃস্তিতি ঘটে।
সুলতান ফিরোজ শাহ এর মৃত্যুর পর তার পুত্র গিয়াস উদ্দিন বাহাদুরও লাখনৌতির স্বাধীনতার পতাকা উড্ডীন রাখেন। ক্ষমতায় অধিষ্টিত হওয়ার পথে,মনে হয়,সুলতান গিয়াস -উদ-দিন বাহাদুর তার অনান্য ভাইদের পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়ে নিজের পথ পরিষ্কার করে নেন। কিন্তু তার কনিষ্ঠ ভাই নাসির-উদ-দিন ইব্রাহিম জীবিত থেকে বাহাদুরের বিরুদ্ধে দিল্লির সুলতান গিয়াস -উদ-দিন তুগরিলের সাহায্য কামনা করেন। হৃষ্টচিত্তে দিল্লির সুলতান এই সুযোগ গ্রহণ করেন। যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। বাংলার সুলতান বীর বিক্রমে যুদ্ধ করে প্রথমে দিল্লি বাহিনীকে ব্যাতিব্যাস্ত করে তোলেন।
কিন্তু পরে দিল্লি বাহিনীর প্রচন্ড আক্রমণে বাংলার সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। সুলতান বাহাদুর পশ্চাদপসরণের সিদ্ধান্ত নেন। কথিত আছে,হারেমের মহিলাদের সাথে নিয়ে পূর্ব বঙ্গের দিকে পলায়নের পথে একটি নদী পার হওয়ার সময় সুলতান বাহাদুরের সওয়ারী বালিতে আটকে যায়। ফলে বাহাদুর শত্রুদের হাতে বন্দি হন। অতঃপর লাখনৌতি অধিকার করেন সুলতান গিয়াস-উদ-দিন তুগলক। যেখানে কিছুদিন থেকে রাজ্যের শাসন-ব্যবস্থা পুনর্গঠন করেন। বাংলাকে তিনি তিনটি শাসন বিভাগে বিভক্ত করেন-লাখনৌতি,সাতগাঁও ও সোনারগাঁও। নাসির-উদ-দিন ইব্রাহিম কে লাখনৌতির এবং বাহরাম খানকে সাতগাঁও ও সোনারগাঁও-এর শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন।
অতঃপর সুলতান তুগলক বন্দি বাহাদুর কে সঙ্গে নিয়ে দিল্লি অভিমুখে যাত্রা করেন। কিন্তু দিল্লি পৌঁছার আগেই দিল্লি থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরে অবস্থিত আফগানপুরে এক অস্বাভাবিক দুর্ঘটনায় সুলতান গিয়াস-উদ-দিন তুঘলকের মৃত্যু হয়। দিল্লির মসনদে সমাসীন হন সুলতান পুত্র মুহম্মদ বিন তুগলক।
মসনদে আরোহনের পরেই নতুন সুলতান বাংলার শাসন ব্যাবস্থায় ব্যাপক রদবদল সাধন করেন। সুলতান মুহম্মদ বিন তুগলক ছিলেন খুবই ধুরন্ধর এক শাসক ;কাউকেই তিনি পুরোপুরি বিশ্বাস করতেন না। গিয়াস উদ্দিন বাহাদুর কে তিনি মুক্তি দিলেন এবং বাহরাম খানের সঙ্গে যুগ্ন শাসনকর্তা নিযুক্ত করে সোনারগাঁও এ পাঠিয়ে দিলেন। শর্ত থাকলো,গিয়াস উদ্দিন বাহাদুর সোনারগাঁ এ দিল্লি সুলতানের নামে মুদ্রা প্রচলন করবেন এবং খোৎবা পথ করবেন।
তদুপরি বাহাদুর তার ছেলে মুহম্মদকে দিল্লির দরবারে পাঠিয়ে দিবেন। অন্যদিকে সুলতান মুহম্মদ বিন তুগলক লাখনৌতি থেকে নাসির উদ-দিন ইব্রাহিম কে নিয়ে এলেন দিল্লিতে এবং মালিক পিন্দর খিলজীকে কদর খান উপাধী দিয়ে লাখনৌতির শাসনকর্তা হিসাবে পাঠালেন ;এবং লাখনৌতি তে মুসতউফি বা হিসাব রক্ষক নিযুক্ত করে পাঠালেন আবু রাজাকে।
সাতগাঁও-এর শাসনকর্তা থাকলেন মল্লিক ইযয-উদ-দিন ইয়াহিয়া ,তার উপাধি হলো আজম-উল-মূলক।
এইভাবে সাজানো হলো বাংলার শাসন-ব্যবস্থা। দিল্লির সুলতান নিশ্চয়ই ভেবেছিলেন ,এতে করে বাংলার বিদ্রোহ-সম্ভাবনা দূর হয়ে গেলো। কিন্তু আবার তাতে বাদ সাধলেন সোনারগাঁও -এর যুগ্ন শাসনকর্তা গিয়াস-উদ-দিন বাহাদুর। শর্তানুযায়ী নিজ পুত্রকে তো দিল্লিতে পাঠালেনই না ,কিন্তু অধিকন্তু দিল্লির চাপের মুখে তিনি আবার বাংলায় ওড়ালেন স্বাধীনতার পতাকা।
এবার বাহাদুরকে দমন করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন বাহরাম খান। শেষতক সুলতান গিয়াস-উদ-দিন বাহাদুর কে পরাজিত ও হত্যা করে বাহরাম খান দিল্লিতে এই সুখবর পাঠান। সুলতান বাহাদুরের স্বাধীনতা প্রয়াসের সমাপ্তি ঘটে ১৩২৭-২৮ সালে।
২৬ ক.বাহরাম খান (১৩২৮-১৩৩৮ সাল )
এখানে পুনরাবৃত্তি করা যেতে পারে যে ,বাহরাম খান ১৩২২ সাল থেকেই গিয়াস-উদ-দিন বাহাদুরের সময়ের জটিলতার সময়ে সোনারগাঁ ও সাতগাও এর শাসনকর্তা হিসেবে কাজ করেছিলেন।তারপর কিছুদিন গিয়াস-উদ-দিন বাহাদুরের সঙ্গে যুগ্নভাবে সোনারগাঁও এর শাসনকর্তা এবং ১৩২৮ সালের বাহাদুরের পরাজয় এবং মৃত্যুর পর এককভাবে সোনারগাঁও এর শাসনকর্তা থাকেন প্রায় ১০ বছর ,১৩২৮ সাল থেকে ১৩৩৮ সাল পর্যন্ত। ১৩৩৮ সালে তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হন।
২৬.খ মালিক ইযয-উদ-দীন ইয়াহিয়া (১৩২৫-১৩৩৮ সাল )
১৩২৫ সালে সুলতান গিয়াস-উদ-দীন তুঘলকের মৃত্যুর পর সুলতান মুহম্মদ বিন তুগলক মালিক ইযয-উদ-দীন ইয়াহিয়া কে সাতগাঁও-এর শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। তার উপাধি হয় আযম- উল-মূলক। ১৩৩৮ সাল পর্যন্ত তিনি ওই পদে সমাসীন ছিলেন।
২৬.গ কদর খান (১৩২৫-১৩৩৮ সাল )
দিল্লির নতুন সুলতান মুহম্মদ বিন তুগলক এর বাংলার শাসন ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস এর সুবাদে লাখনৌতি শাসনের দায়িত্ব ন্যাস্ত হয় কদর খানের উপর। কদর খান হচ্ছে উপাধি,প্রকৃত নাম মালিক পিন্দর খিলজি।
ওদিকে বিচিত্র-চরিত্র সুলতান মুহম্মদ বিন তুগলক এর হাতে পড়ে দিল্লি সালতানাতের অবস্থায়ও খুব নড়বড়ে হয়ে পড়ে। ১৩২৫ সাল থেকে ১৩৩৫ সাল পর্যন্ত মুহম্মদ বিন তুগলক এর শাসনকালে সালতানাতের অবস্থা বেশ ভালোই ছিলো। ঐ সময়ে সুলতান অনেক পরিকল্পনা করেন,কিন্তু সেসব পরিকল্পনা ব্যার্থতায় পর্যবসিত হয়।১৩৩৫ সালের পর সম্রাজ্যের নানা অংশে গোলযোগ দেখা দেয়। বিদ্রোহের পর বিদ্রোহ সংঘটিত হতে থাকে। আর সেসব বিদ্রোহ দমনের জন্য সুলতান কে ছুটে যেতে হয় স্থান থেকে স্থানান্তরে।
কিন্তু বাংলার অবস্থা তখন শান্ত। বাংলার তিনটিবিভাগে ১৩৩৫ সাল থেকে ১৩৩৮ সাল পর্যন্ত এই তিন বছর শাসনকর্তা নির্বিগ্নে শাসণ পরিচালনা করেন। কিন্তু ১৩৩৮ সাল থেকে বাংলার পরিস্থিতি হঠাৎ করেই বদলে যায়। ১৩৫১ সালে মৃত্যুর মুখে পতিত হন দিল্লির সুলতান মুহম্মদ বিন তুগলক। ১৩৩৫ সালের পরে তার রাজত্বের পুরো সময়টাই ছিল তার জন্য চরম দুরবস্থার সময়। তার সম্রাজ্যময় নানা দুর্বিপাক-খরা ,দুর্ভিক্ষ ,বিদ্রোহ। সুদূর এই বাংলায় তখন স্বাধীনতার স্পৃহা তুঙ্গে অবস্থিত। একের পর এক তিনটি বিভাগ -সোনারগাঁও ,লাখনৌতি ,সাতগাঁও এ উড্ডীন হয় স্বাধীনতার পতাকা। তারপর ১৩৫২ সালে রূপ লাভ করে একীভূত স্বাধীন ''বাঙ্গালা '
এর আগেও অবশ্য কোনো কোনো সময় বাংলার শাসনকর্তাগণ স্বাধীনতা ঘোষণা করে স্বাধীন সুলতান হিসেবে দেশ শাসন করেছেন। আবার ঘটনা চক্রে দিল্লি সালতানাতের অধীনতা বরণ করেছেন। পূর্বেকার শাসনকর্তাদের মধ্যে স্বাধীন সুলতান হিসাবে লাখনৌতি রাজ্য শাসন করেছেন যারা ,তাদের মধ্যে ছিলেন আলী মর্দান খিলজি ,হুসাম -উদ-দিন ইওজ খিলজী ,মুগিস উদ-দীন তুগরল ,নাসির উদ্দিন মাহমুদ বুগরা খান,রুকন-উদ-দীন কায়কাউস ,শামস-উদ-দীন ফিরোজ শাহ দেহলবী এবং গিয়াস-উদ-দীন বাহাদুর। এই স্বাধীনতার সময়ে আবার ধুলোয় বিলুন্ঠিত হয়েছে।
কিন্তু ১৩৩৮ সাল থেকে যে সাধীনতার আরম্ভ তার স্থায়িত্বকাল ছিলো পুরো দুশো বছর। এই দু শো বছরের ইতিহাস বাংলার ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায়ের ইতিহাস।এই সময়ে বাংলার সুলতানরা নিজেদের যোগ্যতা ,শক্তি ও ঐশ্বর্যের মদ্ধে দিয়ে ভারতবর্ষের শ্ৰেষ্ঠ নৃপতিদের অন্যতম হয়ে উঠেছিলেন। শুধু তাই নয় ,তারা দেশের অভ্যন্তরীন শাসন ব্যবস্থা পরিচালনায় এবং রাজার নানা কর্তব্য পালনেও অপরিসীম দক্ষতা দেখিয়ে গিয়েছেন। তার ফলে তারা বাংলার মানুষের আস্থা ও ভালোবাসা অর্জন করেছিলেন।
Post a Comment