১১৭৪ সালের মার্চে নুরউদ্দিন একটি ভূমিকম্পের পর বাগদাদে ফিরে আসেন। অনেক ঐতিহাসিকের মতে এটি ছিল ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ ভূমিকম্প। নুরউদ্দিন শাসক হিসেবে বিপর্যয়ের খবর শোনার পর ফিরে আসেন। শত্রু তার অনুপস্থিতির সুযোগ নিতে থাকে।
পরবর্তী সপ্তাহগুলোতে তার সমস্ত মনোযোগ জনগণের উপর ছিল যার ফলে তিনি বিশ্বাসঘাতকত ও হাসান সাহাবর দল যাদেরকে ক্রুসেডাররা সমর্থন করত তাদের কাছ থেকে তার প্রতি হুমকির কথা উপেক্ষা করেন। ১১৭৪ সালের এপ্রিলের শেষের দিকে বিষপ্রয়োগের ফলে গলায় ব্যথা অনুভব করার পর থেকে সমস্যার প্রথম সূত্র পাওয়া যায়।
তার চিকিৎসকদের অনেক প্রচেষ্টার পর নুরউদ্দিন ১১৭৪ সালের ১৫ মে মৃত্যুবরণ করেন। কিছু শক্তিশালী অভিজাত ব্যক্তির দল নুরউদ্দিনের ক্ষমতা তার এগারো বছর বয়সী পুত্র আস সালিহ ইসমাইল আল মালিকের উপর অর্পণ করেন। তার মৃত্যুর ফলে সালাহুদ্দিন ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে তার শক্তিশালী মিত্র হারিয়ে ফেলেন।
সালিহর কাছে লেখা চিঠিতে তিনি জানান যে তিনি তার শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই করবেন এমনকি তারা যদি মুসলিম দাবিও করে যদিনা তিনি ও তার সমর্থকরা নুরউদ্দিনের নীতির বিরুদ্ধে গিয়ে ক্রুসেডারদের সাথে মিত্রতা থেকে বিরত থাকেন।
নুরউদ্দিনের মৃত্যুর পর সালাহুদ্দিন কঠিন সিদ্ধান্তের মুখোমুখি হন। তিনি মিশর থেকে ক্রুসেডারদের উপর আক্রমণ করতে পারতেন অথবা সিরিয়ায় সালিহর কাছ থেকে আমন্ত্রণ লাভ করার আগ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারতেন। এছাড়াও বিদ্রোহীদের হাতে পড়ার আগেই তিনি সিরিয়াকে তার শাসনের অংশে পরিণত করতে পারতেন।
কিন্তু ইতঃপূর্বে তার প্রভুর অধীন ছিল অঞ্চলে হামলা করলে তা তার অনুসৃত ইসলামি বিধানের লঙ্ঘন হতে পারে এবং এই ঘটনা তাকে একজন প্রতারক হিসেবে তুলে ধরতে পারে যা ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বাধা তৈরি করবে এমন আশঙ্কা করেন। তিনি দেখতে পান যে সিরিয়া অধিকার করার জন্য তাকে হয় সালিহর কাছ থেকে আমন্ত্রণ পেতে হবে বা তাকে সাবধান করতে হবে যে ক্রমবর্ধমান নৈরাজ্য ক্রুসেডারদের তরফ থেকে হামলার আশঙ্কা তৈরী করবে।
সালিহ যখন আগস্টে আলেপ্পোতে চলে যান তখন শহরের আমির ও নুরউদ্দিনের দক্ষ সেনাদের প্রধান গুমুশতিগিন তার উপর অভিভাবকত্ব দাবি করেন। তিনি দামেস্ক থেকে শুরু করে সিরিয়া ও জাজিরাতে তার সকল বিরোধীকে পদচ্যুত করার প্রস্তুতি নেন। এই জরুরি অবস্থায় দামেস্কের আমির মসুলের দ্বিতীয় সাইফউদ্দিন গাজিকে সাহায্য চেয়ে বার্তা পাঠান।
কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। এর ফলে সালাহুদ্দিনের কাছে সাহায্য চাওয়া হয় এবং তিনি তা প্রদান করেন। সালাহুদ্দিন ৭০০ বর্শাধারী ঘোড়সওয়ার নিয়ে যাত্রা করেন। কেরাক পার হয়ে তিনি বুসরা পৌছান। তার বর্ণনা অনুযায়ী “এখানে আমির, সৈনিক ও বেদুইনরা তার সাথে যোগ দেয় এবং তাদের অন্তরের অনুভূতি তাদের চেহারায় ফুটে উঠে।“ ২৩ নভেম্বর তিনি দামেস্কে ফিরে আসেন।
দামেস্কের দুর্গে প্রবেশের আগ পর্যন্ত তিনি তার পিতার পুরনো বাসগৃহে অবস্থান নেন। চারদিন পর দুর্গ উন্মুক্ত হয়। তিনি এরপর দুর্গে অবস্থান নেন এবং নাগরিক আতিথেয়তা গ্রহণ করেন।
পরবর্তী অভিযান
ভাই তুগতিগিনকে দামেস্কের গভর্নর হিসেবে রেখে সালাহুদ্দীন পূর্বে নুরউদ্দিনের অধিকারে থাকা আংশিক স্বাধীন শহরসমূহের দিকে রওনা দেন। তার সেনাবাহিনী হামা সহজে দখল করে নেয়। তবে তারা দুর্গের ক্ষমতার জন্য হিমস আক্রমণ এড়িয়ে যান। সালাহুদ্দিন উত্তরে আলেপ্পোর দিকে যাত্রা করেন।
গুমুশতিগিন ক্ষমতাত্যাগে অস্বীকৃতি জানালে ৩০ ডিসেম্বর তা অবরোধ করা হয়। সালাহুদ্দিনের কাছে বন্দী হতে পারে ভেবে সালিহ প্রাসাদের বাইরে এসে অধিবাসীদের কাছে আবেদন জানায় যাতে তারা আত্মসমর্পণ না করে। সালাহুদ্দিনের একজন বর্ণনা লেখকের মতানুযায়ী "জনতা তার কথার জাদুতে চলে আসে।"
সেসময় সিরিয়ায় হাশাশিনদের প্রধান ছিলেন রশিদউদ্দিন সিনান ফাতেমীয় খিলাফত উচ্ছেদ করার কারণে সালাহুদ্দীনের প্রতি বিরূপ ছিলেন। গুমুশতিগিন তাকে অনুরোধ করেন যাতে সালাহুদ্দিনকে তার ক্যাম্পে হত্যা করা হয়।
১১৭৫ সালের ১১ মে তেরজন হাশাশিনের একটি দল সালাহুদ্দিনের ক্যাম্পে সহজে প্রবেশ করে কিন্তু আবু কুবাইসের নসিহউদ্দিন খুমারতেকিন কর্তৃক চিহ্নিত হয়ে পড়ে। সালাহুদ্দিনের একজন সেনাপতির হাতে একজনের মৃত্যু হয় এবং অন্যান্যদের পালানোর সময় হত্যা করা হয়। সালাহুদ্দিনের অগ্রগতি প্রতিহত করার জন্য তৃতীয় রেমন্ড নহরুল কবিরের কাছে তার সেনাদের সমবেত করেন।
মুসলিম অঞ্চল আক্রমণের জন্য এটি তাদের কাছে উপযুক্ত ছিল। সালাহুদ্দিনের এরপর হোমসের দিকে যাত্রা করেন। কিন্তু শহরের দিকে সাইফউদ্দিনের কাছ থেকে একটি সাহায্যকারী বাহিনী পাঠানো হয়েছে শুনে ফিরে আসেন।
ইতিমধ্যে সিরিয়া ও জাজিরায় সালাহুদ্দীনের প্রতিপক্ষরা তার বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা যুদ্ধ শুরু করেন। তারা দাবি করতে থাকে সালাহুদ্দিন তার নিজের অবস্থা (নুরউদ্দিনের অধীনস্থ) ভুলে গেছেন এবং সাবেক প্রভুর সন্তানকে অবরোধ করে তার প্রতি কোনো সম্মান দেখাচ্ছেন না। সালাহুদ্দিন অবরোধ তুলে নিয়ে প্রপাগান্ডা শেষ করার লক্ষ্য স্থির করেন।
তিনি দাবি করেন যে তিনি ক্রুসেডারদের কাছ থেকে ইসলামকে রক্ষা করছেন। তার সেনারা হামা ফিরে এসে সেখানকার ক্রুসেডার সেনাদের মুখোমুখি হয়। ক্রুসেডাররা এখান থেকে ফিরে যায়। সালাহুদ্দিন ঘোষণা করেন যে এটি "মানুষের অন্তরের দরজা উন্মুক্তকারী বিজয়"। এরপর শীঘ্রই ১১৭৫ সালের মার্চে তিনি হিমস প্রবেশ করেন এবং এর দুর্গ অধিকার করেন।
সালাহুদ্দিনের সাফল্য সাইফউদ্দিনকে সতর্ক করে তোলে। জেনগিদের প্রধান হিসেবে তিনি সিরিয়া ও মেসোপটেমিয়াকে তার পরিবারের বলে বিবেচনা করতেন এবং সালাহুদ্দিন কর্তৃক তার বংশের অধিকৃত স্থান দখল করায় রাগান্বিত হয়ে পড়েন। সাইফউদ্দিন একটি বড় আকারের সেনাদল গঠন করে আলেপ্পোর দিকে পাঠান।
আলেপ্পোর প্রতিরোধকারীরা এর আশঙ্কায় ছিল। মসুল ও আলেপ্পোর যৌথ বাহিনী হামায় সালাহুদ্দিনের বিরুদ্ধে অগ্রসর হয়। প্রথমে সালাহুদ্দিন দামেস্ক প্রদেশের উত্তর দিকের সমস্ত বিজিত এলাকা ত্যাগ করার মাধ্যমে জেনগিদের সন্ধি করতে চেষ্টা করেন। কিন্তু তারা তা প্রত্যাখ্যান করে এবং তাকে মিশর ফিরে যেতে বলা হয়।
সংঘর্ষ অনিবার্য দেখতে পেয়ে সালাহুদ্দিন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হন। যুদ্ধে সালাহুদ্দিনের বাহিনী বিজয়ী হয়। এ বিজয়ের ফলে সালিহর উপদেষ্টারা সালাহুদ্দিনকে দামেস্ক, হিমস ও হামা এবং আলেপ্পোর বাইরের কিছু শহরে সালাহুদ্দিনের নিয়ন্ত্রণ মেনে নিতে বাধ্য হয়।
জেনগিদের বিরুদ্ধে বিজয়ের পর সালাহুদ্দিন নিজেকে রাজা ঘোষণা করেন। সালিহর নাম জুমার খুতবা ও মুদ্রা থেকে বাদ দেয়া হয়। বাগদাদের আব্বাসীয় খলিফা সালাহুদ্দিনের ক্ষমতাপ্রাপ্তিকে স্বাগত জানান এবং তাকে মিশর ও সিরিয়ার সুলতান হিসেবে ঘোষণা করেন। আইয়ুবী ও জেনগিদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই হামার যুদ্ধের পর শেষ হয়ে যায়নি। সাইফউদ্দিন ক্ষুদ্র রাজ্য দিয়ারবাকির ও জাজিরা থেকে সেনা সংগ্রহ করার সময় সালাহুদ্দিন মিশর থেকে ব্যাপক সেনা সমাবেশ করেন।
তিনি আলেপ্পো থেকে ২৫ কিমি দূরে তিল সুলতানে পৌছান এবং সেখানে সাইফউদ্দিনের সেনাদের সাথে লড়াই হয়। জেনগিরা সালাহুদ্দিনের বাহিনীর বাম অংশকে ভেঙে ফেলতে সক্ষম হয়। এসময় সালাহুদ্দিন জেনগিদের প্রধান অংশকে আক্রমণ করেন। জেনগি সেনারা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে।
সাইফউদ্দিনের অধিকাংশ অফিসাররা নিহত বা বন্দী হয়। সাইফউদ্দিন পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। জেনগি সেনা ক্যাম্প, ঘোড়া, মালামাল, তাবু ইত্যাদি আইয়ুবীদের হস্তগত হয়। যুদ্ধবন্দীদের মুক্তি দেয়া হয়। যুদ্ধলব্ধ সম্পদ সেনাদের মধ্যে বিলিয়ে দেয়া হয়। তবে সালাহুদ্দিন নিজের জন্য কিছু রাখেননি।
তিনি আল্লেপোর দিএক এগিয়ে যান। যাত্রাপথে তার সেনারা বুজা ও এরপর মানবিজ অধিকার করে। এখান থেকে তারা পশ্চিমে আজাজ দুর্গ অবরোধের জন্য এগিয়ে যায়। কয়েকদিন পর সালাহুদ্দিন তার এক সেনাপতির তাবুতে বিশ্রাম নেয়ার সময় এক হাশাশিন তাকে ছুরি দিয়ে মাথায় আক্রমণ করেন।
তার শিরস্ত্রাণের ফলে হামলা সফল হয়নি। তিনি হামলাকারীকে ধরে ফেলেন। আততায়ীকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার জন্য তিনি গুমুশতিগিনকে দায়ী করেন এবং অবরোধে শক্তিবৃদ্ধি করেন।
২১ জুন আজাজ অধিকৃত হন। গুমুশতিগিনকে মোকাবেলা করার জন্য সালাহউদ্দদিন তার সেনাদেরকে আলেপ্পোর দিকে পাঠান। তার হামলা এবারও প্রতিহত করা হয়। তিনি একটি সন্ধি ও আলেপ্পোর সাথে পারস্পরিক মিত্রতা স্থাপন করা হয়।
এতে গুমুশতিগিন ও সালিহকে শহরে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে হয় এবং বিনিময়ে তারা সালাহুদ্দিনকে তার অধিকৃত সকল এলাকায় সার্বভৌম হিসেবে মেনে নেয়। মারদিন ও কাইফার আমিররা সালাহুদ্দীনকে সিরিয়ার রাজা হিসেবে মেনে নেয়।
হাশাশিনদের সাথে দ্বন্দ্ব
সালাহুদ্দিন তার প্রতিপক্ষ জেনগি ও জেরুজালেম রাজ্যের (১১৭৫ এর গ্রীষ্মে অধিকার করে নেয়া হয়) সাথে চুক্তিতে আসলেও রশিদউদ্দিন সিনানের নেতৃত্বাধীন হাশাশিনদের হুমকির সম্মুখীন হন। নুসাইরিয়া পর্বতমালায় তাদের ঘাঁটি ছিল। তারা নয়টি দুর্গ নিয়ন্ত্রণ করত। এগুলো সবই উচ্চভূমিতে অবস্থিত ছিল।
সালাহুদ্দিন ১১৭৬ সালের আগস্টে নুসাইরিয়া রেঞ্জে তার সেনাবাহিনীকে নিয়ে যান। একই মাসে ব্যর্থ হয়ে পিছু হটতে হয়। অধিকাংশ মুসলিম ইতিহাসবিদদের মতে সালাহুদ্দিনের চাচা, হামার গভর্নর সিনান ও সালাহুদ্দিনের মধ্যে শান্তিচুক্তির মধ্যস্থতা করেন।
হাশাশিনদের গুপ্ত ঘাঁটি আক্রমণ করলে তারা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। তিনি তার রক্ষীদের সংযোগ আলো সরবরাহ করেন এবং তার তাবুর চারপাশে খড়ি ও কয়লা ছিটিয়ে দেয়া হয় যাতে হাশাশিনদের পদচিহ্ন শনাক্ত করা যায়। এই বিবরণ অনুযায়ী, একরাতে সালাহুদ্দিনের রক্ষীরা মাসাইফ পাহাড়ে আলোর স্ফুলিংগ দেখতে পায় এবং তা আইয়ুবী তাবুর মধ্যে হারিয়ে যায়।
এসময় সালাহুদ্দিন জেগে উঠে কাউকে তার তাবু থেকে বের হয়ে যেতে দেখতে পান। তার বিছানার পাশে বিষাক্ত ছুরির সাথে গেথে দেয়া একটি বার্তা পাওয়া যায়। এতে লেখা ছিল যে তিনি যদি তার এই অভিযান বন্ধ না করেন তবে এজন্য তার মৃত্যু হতে পারে। সালাহুদ্দিন চিৎকার দিয়ে উঠেন এবং দাবি করেন সিনান নিজেই তার তাবুতে এসেছিল।
অন্য একটি বিবরণ অনুযায়ী সালাহুদ্দীন তার সেনাদের সরিয়ে নিয়েছিলেন কারণ লেবানন পর্বতের কাছে একটি ক্রুসেডার দলকে প্রতিহত করা জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ছিল। হাশাশিনরা তার সাথে একপ্রকার মিত্রতা স্থাপন করতে চায়। ক্রুসেডারদের বিতাড়নে পারস্পরিক লাভ আছে বিবেচনা করে সালাহুদ্দীন ও সিনান এরপর সহযোগিতার সম্পর্ক বজায় রাখেন এবং সালাহুদ্দীনের সেনাদের শক্তিবৃদ্ধির জন্য কিছু লড়াইয়ে সিনান সেনাসরবরাহ করেন।
Post a Comment