উটের যুদ্ধ :ইসলামের ইতিহাসে প্রথম গৃহযুদ্ধ
৬৫৬ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে ইরাকের বসরায় সংঘটিত হয়। ইসলামের ইতিহাসে প্রথম গৃহযুদ্ধ বা উটের যুদ্ধ নামে পরিচিত। এই যুদ্ধ ছিল ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রাঃ) এর বিরুদ্ধে তালহা - হযরত জুবায়ের (রাঃ) ও আয়েশা (রাঃ) সম্মিলিত যুদ্ধ।
তৃতীয় খলিফা হযরত উসমান (রাঃ) হত্যাকান্ড
ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা উমর ইবনে খাত্তাব মৃত্যুবরণ করার পরে ইসলামের তৃতীয় খলিফা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন উসমান। উসমান এর বিভিন্ন প্রদেশে প্রাদেশিক শাসনকর্তা নিয়োগ নিয়ে একদল তার বিরুদ্ধে অভিযোগ টেনে বিদ্রোহ শুরু করে। উসমান বিভিন্নভাবে তাদের শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকেন।
তাদের কথামত মিশরের গভর্নরকে প্রতিস্থাপন করে আবু বক্করের ছেলে মুহাম্মদ ইবনে আবু বক্কর কে নিয়োগ করলেও বিদ্রোহীরা শান্ত হননি। তারা নানাভাবে অভিযোগ টেনে এনে ওসমানকে অপসারণের দাবি করতে থাকে। উসমান সবকিছুর মীমাংসার আশ্বাস দিলেও তারা ৬৫৬ সালের ১৭ জুন উসমানের বাড়ি অবরুদ্ধ করে এবং এক পর্যায়ে তারা তার কক্ষে প্রবেশ করে কুরআন তেলাওয়াত অবস্থায় হত্যা করে।
হযরত আলীর (রাঃ) খেলাফত
হযরত উসমান মৃত্যুবরণের পর ইসলামের চতুর্থ খলিফার দায়িত্ব গ্রহণ করেন আলী ইবনে তালিব। তিনি দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে সারা মহল থেকে উসমান হত্যার বিচারের দাবি আসে। তালহা ও জুবায়ের আলী এর খিলাফত সমর্থন করেছিল মূলত উসমান হত্যা বিচারের জন্য। এমনকি কিছু কিছু মহল থেকে দাবি উঠে উসমান হত্যা কারীদের দ্রুত মৃত্যুদণ্ড প্রদানের জন্য।
মা আয়েশা (রাঃ) , তালহা ইবনে উবাইদিল্লাহ ও জুবায়ের ইবনুল আওমকে সমর্থন করে উসমান হত্যা বিচারের দাবি জানায়। কিছু ঐতিহাসিকের মতে আলীর বিরুদ্ধে আয়েশার (রাঃ) কিছু ব্যাক্তিগত বিদ্বেষ ছিল যা এই সমর্থনকে প্রাণ জুগিয়েছিল। কিন্তু আরব বেদুইন ও ক্রীতদাসরা ইসলামী সম্রাজ্য ভাঙ্গন সৃষ্টি করবে বিধায় আলী আন্দোলোনকারীদের কিছু দিন অপেক্ষ ও শান্ত হতে বলেন। এভাবে দীর্ঘ ৪ মাস অপেক্ষা করার পরেও উসমান হত্যার বিচার হচ্ছিলো না।
উটের যুদ্ধ পূর্ব ঘটনা
এদিকে আলী (রাঃ ) খলিফার দায়িত্ব গ্রহণ করেই বিভিন্ন প্রদেশে নতুন নতুন প্রাদেশিক কর্মকর্তা নিয়োগ দান করেন এবং পুরাতন সাহাবাদের পদত্যাগ করতে অনুরোধ করেন। অনেকে আলীর অনুরোধে পদত্যাগ করলেও সিরিয়ার প্রাদেশিক শাসনকর্তা মুয়াবিয়া তার নির্দেশ অমান্য করে এবং পদত্যাগ করতে অস্বীকার করেন।
উসমান হত্যার বিচারের বিলম্বতা সহ্য না করতে পেরে আয়েশা (রাঃ) , তালহা ও জুবাইয়ের কে নিয়ে ইরাক, মক্কা ও মদিনা থেকে ৩০০০ সৈন্য সংগ্রহ করে বসরার দিকে অগ্রসর হন। ৬৫৬ খ্রিস্টাব্দে ১৯ অক্টোবর বসরা আক্রমণ করে বসরার শাসক হানিফাকে বন্দি করেন। হযরত আলী বিদ্রোহীকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে না চাইলে ও আয়েশা (রাঃ) এর বসরা আক্রমণ তাকে অস্ত্রধারণ করতে বাধ্য করে।
তখন কাফেলা নিয়ে মুয়াবিয়াকে দমন করতে যাচ্ছিলেন। বসরা আক্রমণের খবর শুনে তিনি যুদ্ধ কাফেলা ঘুরিয়ে বসরার দিকে রওনা হন। তার সাথে পর্যাপ্ত সৈন্য না থাকার কারণে কুফাতে অবস্থান করেন। তিনি কুফাকে রাজধানী করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও কুফার জনগণ আলীর পক্ষ নিয়ে যুদ্ধ করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করে।
পরে আলীর পুত্র হাসানের সহযোগিতায় ১০ হাজার সৈন্য নিয়ে বসরার অভিমুখে যাত্রা করেন। খলিফা হিসেবে আবারো আয়েশা (রাঃ) , তালহা জুবাইয়েরকে প্রস্তাব করেন যে , খিলাফতের প্রাথমিক সঙ্কট কেটে গেলেই তিনি উসমান হত্যার বিচার করবেন। এই মর্মে তিনি আয়েশার (রাঃ) নিকট শান্তি প্রস্তাব করেন। তালহা ও আয়েশা (রাঃ) আলী এর প্রস্তাব মেনে নিয়ে শান্তি চুক্তিতে রাজি হন।
মূল যুদ্ধ ঘটনা
এদিকে প্রাথমিক শান্তি চুক্তি সম্পাদন হয়ে গেলে দুষ্কৃতিকারী "ইবনে সাবাহ " এর সমর্থকদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। তারা ধারণা করে বসে শান্তি প্রতিষ্টা হয়ে গেলে উসমান হত্যা বিচারে তারাই প্রথম শিকার হবে। তাই ৬৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর আশতার , নাখয়ী ইবনে সাওদা সহ তাদের দলের আরও কয়েকজন আলী ও আয়েশা উভয় শিবিরেই আক্রমণ করে।
তৃতীয় পক্ষ আক্রমণ করার ফলে দুই পক্ষের মধ্যেই ভুল বোঝাবুঝি হয়। তাদের আঁধারে আক্রমণ হলে ভোর হতেই দুই দলের মধ্যে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে প্রচন্ড যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। আর এটাই সর্ব প্র্রথম মুসলমানদের বিরুদ্ধে মুসলমানের অস্ত্র ধারণ। দুই দলের মধ্যে তুমুলভাবে যুদ্ধ চললেও কোন দলই এই যুদ্ধ চায় নি। বরঞ্চ ছিল তৃতীয় পক্ষের ষড়যন্ত্রের ফলে একটি ভুল বোঝাবুঝি।
এই যুদ্ধ চলাকালীন সময়েই পুনরায় আলী তালহা ও জুবায়েরকে শান্তি প্রতিষ্ঠার আহবান জানান ও যুদ্ধ বন্ধ করতে অনুরোধ করেন। তারা আলী এর কথা মেনে নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে ফেরত যাওয়ার পথে উভয়ই হত্যার শিকার হন। জুবায়ের কে ঘুমন্ত অবস্থায় হত্যা করে আমর বিন জুরমুজ। আর তালহা জনৈক ব্যক্তির তীরের আঘাতে নিহত হয়। ফলে যুদ্ধ সমাপ্ত না ঘটে যুদ্ধ পুনরায় আবার আয়েশার নেতৃত্বে পুরোদমে চলতে থাকে। যুদ্ধে আয়েশা উটের উপরে থেকে পরিচালনা করেছিলেন বিধায় এই যুদ্ধ উটের যুদ্ধ নামে পরিচিত।
ফলাফল
প্রচন্ড যুদ্ধের এক পর্যায়ে আয়েশা এর দল পরাজয় বরণ করেন। উভয় দলেই প্রচুর ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখীন হয়.আলী মুহাম্মদ সাঃ এর স্ত্রী আয়েশা কে সসম্মানে তার ভাই মুহাম্মদ ইবনে আবু বকরের নিকট মদিনায় পাঠিয়ে দেন। এবং শত্রুপক্ষ খুশি হয় ,এবং উম্মাহর মধ্যে ফাটল তৈরি করে।
ঐতিহাসিকদের দৃষ্টিকোণ
ইসলামের প্রথম গৃহযুদ্ধ হিসাবে এই যুদ্ধের তাৎপর্যতা অনেক বেশি।ঐতিহাসিক মুর বলেন ,এই যুদ্ধে প্রায় ১০ হাজার মুসলিম প্রাণ হারান। এটাই প্রথম যুদ্ধ যেখানে মুসলমান মুসলমানদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেন।
এর মাধ্যমেই ইসলামের প্রথম গৃহ যুদ্ধ বা ফেতনা শুরু হয়। ঐতিহাসিক পি,কে হিট্টি বলেন , এই যুদ্ধর সুদূরপ্রসারী ফলাফল হিসেবে এই যুদ্ধ মুসলমানদের খিলাফতকে দুর্বল করে দিয়েছিল।এই যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে উসমান হত্যার বিচারের মধ্য দিয়ে।
আরো পড়ুন :
Post a Comment