গ্রীস ও ট্রয়ের উপাখ্যান: ট্রোজান যুদ্ধের প্রধান ভিত্তি হেলেন  



গ্রীস ও ট্রয়ের উপাখ্যান : ট্রোজান যুদ্ধের প্রধান ভিত্তি হেলেন। পর্ব ০৩



হেলেনের জন্ম সবদিক থেকেই ইল্লেখযোগ্য। হেলেনের মা ছিল অপূর্ব সুন্দরী এবং তার নাম ছিল লেডা। সে ছিল স্পার্টার রাজা টিন্ডারাসের স্ত্রী। আর পিতা ছিল রাজঁহাস। 






একদিন লেডা ইউরোটাস নদীতে গোসল করছিল; এমন সময় দেবতাদের রাজা জিউস তাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে যান। তখন তিনি এক ভয়ঙ্কর ঈগল তৈরি করলেন এবং নিজে সেই ঈগলের ভয়ে ভীত হয়ে এক রাজহাঁসের রূপ ধারণ করলেন, লেডা সেই রাজহাঁসটিকে দু হাত দিয়ে আগলে রাখলো। ঈগলটা পালিয়ে গেল। লেডা তখন জানতো না যে এই রাজহাঁসটি দেবতা জিউস। 


সেই রাজহাঁসের ঔরসে লেডা সন্তানের পরিবর্তে ২টা ডিমের জন্ম দেয়। একটা ডিমের ভেতর থেকে জন্ম নেয় হেলেন ও তার ভাই পলিডিউকিস বা পোলাক্স, ওপর ডিমটি থেকে জন্ম নেয় ক্যাস্টর আর ক্লাইটেমনেস্ট্রা। কথিত আছে, হেলেন আর পলিডিউকিস ছিল জিউসের সন্তান, এবং দুজন ছিল লেডার স্বামী টিন্ডারাসের সন্তান। তবে এ বিষয়ে বিভিন্ন কিংবন্তী প্রচলিত আছে। 


আমরা জানি, পলিডিউকিস ও ক্যাষ্টর পৃথিবীতে বহু  রকম অভিযান করে শেষকালে দেবতাদের মধ্যে স্থান পায়, এবং তাদের এমন ক্ষমতা দেওয়া হয় যাতে তারা সমুদ্রঝড়ে পতিত নাবিকদের প্রার্থনা শুনে তাদের সাহায্য করতে না পারে।  তাদেরকে কখনো দেখা যায় জাহাজের মাস্তুলের উপরে আগুনের গোলার আকারে; আবার কখনো দেখা যায় সমুদ্রের ফেনার উপর দিয়ে সাদা ঘোড়ায় চড়ে বেড়াতে। 












হেলেন আর ক্লাইটেমনেস্ট্রা গ্রিসের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী দুই রাজাকে বিয়ে করে।  আট্রিউসের পুত্র আগামেমননকে বিয়ে করে ক্লাইটেমনেস্ট্রা মাইসিনিতে বাস করতে থাকে। তাদের দুই মেয়ে ও এক ছেলে হয় এবং তারাও প্রত্যেকেই বিভিন্নভাবে হতভাগ্য ও বিখ্যাত হয়। মেয়ে দুটির নাম ইফিজিনিয়া আর ইলেকট্রা। ছেলের নাম ওরেস্টিস। ট্রয়ের যুদ্ধের আগে পর্যন্ত ক্লাইটেমনেস্ট্রা ও আগামেমনন তাদের রাজ্যে খুবই সুখ ও সমৃদ্ধি মধ্যে বাস করতে থাকে। 











কিন্তু হেলেনের যখন বিয়ের বয়স হলো, তখন তার স্বর্গীয় রূপের খ্যাতি সারা এমন ভাবে ছড়িয়ে পরে যে, তখনকার গ্রিসের সমস্ত বীরই তাকে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এলো। সুদূর উত্তর গ্রিস থেকে আসে দেবী থেটিসের পুত্র, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম যোদ্ধা, একিলিস। একিলিসের শৈশব ও যৌবনের অনেক কাহিনী আছে। তার মধ্যে এখানে দুটো উল্লেখ করা  যেতে পারে। একিলিসকে তার মা খুবই ভালোবাসতো এবং ছেলে অমর করার জন্য স্টিক্স নদীর জলে তাকে গোসল করত।





 কিন্তু দেবতাদের ইচ্ছাতেই হোক বা তার অবহেলার জন্যই হোক একিলিসের পায়ের গোড়ালি দুটো ভিজতো না। ছেলের পায়ের গোড়ালি দুটো ধরে সে তাকে নদীতে চুবিয়ে নিত। তাই একিলিসের শরীরের শুধু এই অংশটুকুই এমন রয়ে গেল, যেকানে আঘাত করে ক্ষত সৃষ্টি করা যায়। 



পরবর্তী কালে থেটিস স্বয়ং জিউসকে তার ছেলের ভাগ্য সম্পর্কে জিগ্যেস করে ছিল, তখন জিউস বলেছিলেন, একিলিস সুখে-স্বচ্ছন্দে দীর্ঘকাল বাস করে মৃত্যুর পর বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাবে, আর না হয় খু স্বল্পায়ু হবে, অথচ মানুষের মধ্যে তার অনন্ত খ্যাতি থেকে যাবে। শোনা যায় থেটিস তার ছেলেকে দীর্ঘ জীবন বেছেনিতে বলেছিল। কিন্তু একিলিসের কাছে বীরত্ব ও মহত্ব অর্জনই ছিল সবচেয়ে সুখকর, তাই সে স্বল্পমেয়াদি জীবন বেঁচে নিয়েছিল, যা তাকে দেবে চিরন্তন খ্যাতি। 





একিলিস ছাড়াও আরো অনেকেই হেলেন কে বিয়ে করার ইচ্ছা নিয়ে এসেছিলো। পাইলোসের রাজা নেস্টরের বীর পুত্র এন্টিলোকাস তাদের মধ্যে একজন। নেস্টর ছিলেন তার সময়কার সবচেয়ে বৃদ্ধ ও সবচেয়ে জ্ঞানী রাজা। তার যৌবনকালে তিনি হেরাক্লিস, থিসিউস, জেসন প্রমুখ অতীতের বড় বড় বীরকে চিনতেন। তার সঙ্গে সালামিস থেকে তার ভাই টিউকারও এসেছিল। সে ছিল বিখ্যাত তীরন্দাজ। 




এসেছিল ফিলোকটিটিস, হেরাক্লিসের তীরধনুক নিয়ে। হেরাক্লিস যখন মারা যায় তখন এই তীরধনুক সে ফিলোকটিটিসকে দিয়ে যায়। ইথাকা থেকে এসেছিল ওডিসিউস  মানুষের মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী এবং উপায় উদ্ভাবনে সবচেয়ে নিপুন। এত বীর, এত রাজপুত্র ও দেবপুত্র হেলেনকে বিয়ে করতে এসেছিল যে, হেলেনের বড় পছন্দ করা নিয়ে টিন্ডারাস ও লেডা মহামুশকিলে পরে যায়। 




এখন কাকেই বা পছন্দ করবে আর কাকেই বা ফিরিয়ে দেবে। ফিরিয়ে দিলেও কে কী মনে করে কে জানে! শেষ পর্যন্ত নাকি জ্ঞানী অডিসিউসের সুপরামর্শই মেনে নেওয়া হয়েছিল। অডিসিউস বলেছিল, হেলেন তার নিজের ইচ্ছামতো সকলের মধ্যে থেকে তার বর পছন্দ করে নিক - তবে তার আগে সবাইকে প্রতিজ্ঞা করতে হবে যে, হেলেন যাকেই পছন্দ করুকনা কেন, হেলেন ও তার স্বামীকে তারা সবাই আজীবন রক্ষা করবে। 




এই পরামর্শে সবাই রাজি হল।  হেলেন তখন আগামেমননের ভাই স্বর্ণকেশী মেনেলাউসকে স্বামী হিসেবে নির্বাচণ করল।  এই সুপরামর্শ দেবার ফলেই নাকি রাজা টিন্ডারাস তার ভ্রাতুষ্পুত্রী সুন্দরী পেনিলোপের সঙ্গে অডিসিউসের বিয়ে দেন। 



বীরেরা সবাই যার যার দর্শে ফায়ার গেল, যাবার আগে প্রতিজ্ঞা করে গেল, যদি প্রয়োজন হয়, হেলেন ও মেনেলাউসকে রক্ষা করার জন্য তারা সকলেই একসঙ্গে আসবে। হেলেন আর মেনেলাউস স্পার্টায় সুখে-স্বচ্ছন্দে বাস করতে লাগল। তাদের এক মেয়ে হল নাম হার্মিওনি। 







প্যারিস যখন তার অনুচরদের নিয়ে ট্রয় থেকে স্পার্টায় এসে উপস্থিত হল তখন মেনেলাউস ও হেলেন অত্যন্ত অতিথেয়তার সঙ্গে অভ্যর্থনা জানাল।  তাদের জন্য প্রচুর খানাপিনার বেবস্থা করা হল। খাওয়ার পর এক কবি প্রাচীন দিনের কীর্তিগাথা - যেমন হেরাক্লিসের শক্তির কথা, মেলিয়াগারের মৃত্যু, সুবর্ণ মেষ চর্ম ইত্যাদি কাহিনী গেয়ে শুনালো। সে কবি জানতো যে, তার চোখের সামনেই এমন কাহিনীর সূত্রপাত ঘটেছে, যা পরবর্তীকালে সবচেয়ে বিখ্যাত কাহিনীতে পরিণত হবে। 





খাওয়াদাওয়ার পর তারা সবাই গিয়ে শুয়ে পড়ল। মেনেলাউস ও হেলেন গেল ভোজকক্ষের পেছনে তাদের সবার ঘর। প্যারিস ও তার সঙ্গীদের হল প্রাসাদের উঁচু বারান্দায় ভেড়ার চামড়ার কম্বল বিছিয়ে, তার উপর লাল রঙের চাদর বিছিয়ে। দীর্ঘ ভ্রমণের পর তারা সবাই ঘুমিয়ে পড়ল। প্যারিস কিন্তু জেগেই রইল।




 হেলেনকে সে দেখেছে এবং তার কল্পনায় তাকে যতটা সুন্দরী ভেবেছিল তার চেয়েও বেশি সুন্দরী মনে হয়েছে। তার প্রতি যে অতিথিয়তা দেখানো হয়েছে সে কথা ভুলে গেছে,  সে যে তার নিজের দেশের ওপর বিপদ ডেকে আনতে পারে তও তার মনে হল না। 




অনেক দিন সে এই প্রাসাদে রইল। তারপর একদিন যখন মেনেলাউস সমুদ্রযাত্রা করে ক্রিটে গেল, তখন সে হেলেন কে জাহাজে তুলে নিয়ে দ্রুতবেগে ট্রয় অভিমুখে রওয়ানা হল। হেলেন তার সঙ্গে স্বেচ্ছায় চলে গিয়েছিল কি না, আমরা তা জানি না , কিন্তু ট্রয়ের লোকেরা তাকে এমনভাবে অভ্যর্থনা করলো যেন সে প্যারিসেরই স্ত্রী। বৃদ্ধ রাজা হেলেনকে অভ্যর্থনা জানালেন। 



ছেলের এই অপকীর্তিকে সমর্থনও করলেন, কিছুটা হেলেনের খাতিরে এবং কিছুটা গ্রিকরা তার বোন হেসিওনিকে নিয়ে চলে গিয়েছিলো বলে। যাই হোক, প্যারিস ও হেলেনকে অভ্যর্থনা জানিয়ে তিনি যেন এক অভিশাঁপকেই অভ্যর্থনা জানালেন, যা তার এবং তার সন্তানদের এবং তার দেশের চরম ধ্বংস ডেকে আনবে। এ যেন নগরের মধ্যে এক জ্বলন্ত মশাল এসে ঢুকল, ঠিক দৈববানীতে যেমন বলা হয়েছিল।  


আরো পড়ুন :
















Post a Comment