আট্রিউস রাজবংশ  


গ্রীস ও ট্রয়ের উপাখ্যান : আট্রিউস রাজবংশ | পর্ব ০২




গ্রীসের কাছাকাছি পৌঁছে প্যারিসের নৌবহর মার্টিয়া সাগরের নীল জলের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলো। এই মার্টিয়া সাগরের নাম হয়েছে মার্টিলাস নামে এক সারথির নাম অনুসারে। অগমেমেন ও মেনেলাউসের পিতামহ পেলপস এই মার্টিলাসকে অত্যন্ত জঘন্য ভাবে হত্যা করে। আমরা দেখতে পাবো এই পরিবারটির উপর অনেকবার দুর্ভাগ্য নেমে এসেছে এবং বংশপরাম্পরাক্রমে তা দেবতাদের বা মানুষের মনে আঘাত দিয়েছে।


 দেবতাদের মনে আঘাত দিয়েছে অহংকার করে, আর মানুষের মনে আঘাত দিয়েছে অন্যায় ও অবিচার করে। এই বংশের মধ্যে একমাত্র মেনেলাউসই নির্দোষ জীবনযাপন করেছে এবং তিনিই অবশেষে দেবতাদের আশীর্বাদধন্য দ্বীপে স্থান পেয়ে পুরস্কৃত হয়েছিলেন। 











এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন লিডিয়ার ঐশ্বর্যশালী রাজা ট্যান্টালাস। দেবতাদের ভোজসভায় তার প্রবেশাধিকার ছিল। কিন্তু তার মধ্যে এক শয়তানি অহংকার ছিল। দেবতাদের কেমন করে ঠকানো যায়, তাই তিনি সব সময় মনে মনে ভাবতেন এবং ভেবে ভেবে এক নির্মম এবং বর্বর পরিকল্পনা বের করেন। 


তিনি নিজের ছেলে পেলপসকে টুকরো টুকরো করে রান্না করে দেবতাদের খেতে দেন। দেবী ডিমিটার এই ভোজসভায় উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু পাতালের রাজা প্লুটো তার মেয়ে পার্সিফোনিক চুরি করে নিয়ে গেছেন, সেই শোকে তিনি তখন অত্যন্ত মর্মাহত। এই রকম দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে অন্যমনস্কভাবে তিনি ছেলেটির কাঁধের এক টুকরো মাংস খেয়ে ফেলেন। অন্যন্য দেব-দেবীকে কিন্তু ঠকানো গেলো না, তারা বিরক্ত হয়ে টেবিল ছেড়ে অত্যন্ত রাগ করে চলে গেলেন।



 ট্যান্টালাস যেহেতু দেবতাদের ভোজসভায় আহার করেছেন, কাজেই তিনি ছিলেন অমর। তবুও এই দুর্নীতির জন্য তাকে অনন্ত শাস্তি ভোগ করতে হয়। নরকের গভীরতম বন্দিশালায় এখনো তিনি ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় চরম যন্ত্রনা ভোগ করেছেন। ফলভরা বৃক্ষশাখা তার চোখের সামনে দুলতে থাকে, কিন্তু তিনি হাত বাড়িয়ে ধরতেই গেলেই সেগুলো তার নাগালের বাইরে চলে যায়। দিঘিতে পরিষ্কার স্বচ্ছ জল দেখে তিনি তৃষ্ণা মেটাতে যান, কিন্তু দেখতে পান দিঘিভর্তি ছাই কিংবা মরুভূমির বালু। 




অপরাধীকে শাস্তি দেবার পর দেবতারা নিরপরাধ পেলপসকে পুনরায় বাঁচিয়ে তুললেন। আর তার কাঁধের মাংসটুকু খেয়ে ফেলা হয়েছিল বলে দেবতারা তাকে গজদন্তের কাঁধ বানিয়ে দিলেন। এই কাঁধের অলৌকিক ক্ষমতা ছিল। এই কাঁধ ছুলেই যে কোনো দুরারোগ্য ক্ষত সেরে যেত। 






এভাবেই পেলপস ট্রয়ের সীমান্তবর্তী লিডিয়া দেশে বোরো হতে লাগল। কিন্তু তার অদৃষ্ঠে  ছিল অন্যত্র রাজ্য স্থাপন করা। প্রায়াম রাজা হওয়ার অনেক আগে ট্রয়ের এক রাজা লিডিয়া জয় করে নেন এবং তখন পেলপস তার অনুচরদের নিয়ে দক্ষিণ গ্রিসে চলে যায়। সেখানে পিসার রাজা ইনোমাউসের কন্যা হিপোডামিয়াকে দেখে সে তাকে বিয়ে করে চায়। পেলপসের চেহারা ও ঐশ্বর্যের জন্য যে কোনো রাজাই তাকে জামাই করতে রাজি হতেন, কিন্তু রাজা ইনোমাউসের প্রতিজ্ঞা ছিল রথের দৌড়ে তাকে যে পরাজিত করতে পারবে, তার কাছেই তার মেয়েকে দেবেন। আর জড় হেরে যাবে তার হবে মৃত্যুদণ্ড। এ পর্যন্ত ১৩জন যুবক প্রাণ দিয়েছে। 













পেলপস এ কথা জানত। তাই সে এই প্রতিযোগিতায় রাজি হল বটে, কিন্তু রাজার রথের সারথিকে ঘুষ দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বললো, সে যেন রাজার রথের অক্ষদন্তটা ঢিলে করে রাখে, যাতে দৌড়ের সময় মোর নিতে গেলেই সেটা টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পরে, ততক্ষন পর্যন্ত জীবিত থাকলে সে নিশ্চই জয়ী হবে। 





শেষ পর্যন্ত হলও তাই। রাজা ইনোমাউসের রথের চাকা খুলে গেলো, রথের বলগা তার কোমরে জড়িয়ে গেল, পাথুরে জমির উপর দিয়ে ঘোড়াগুলো তাকে হিচড়ে নিয়ে চললো।এভাবেই সেই নিষ্ঠুর রাজার মৃত্যু হল। পেলপস তখন হিমোডামিয়াকে বিয়ে করল। যে জায়গাতে এই রথ প্রতিযোগিতা হয়েছিল, সেই জায়গাতে সমগ্র গ্রিসের জন্য বিখ্যাত অলিম্পিক খেলার প্রচলন করল সে। কিন্তু সেই সারথি মার্তিলাস এসে যখন ঘুষ চাইল তখন সে বিশ্বাঘাতকের মতো অস্বীকার করল। শুধু তাই নয় সে মার্তিলাসকে হত্যা করে সাগরে ফেলে দিলো। মার্তিলাসের নাম অনুসারে সাগরের নাম হল মার্তীয় সাগর। 







এতবড় দুষ্কর্মের পরেও কিন্তু পেলপসের খুব সমৃদ্ধি হতে লাগল। হিপোডিয়াকে রানী করে সে এক বিরাট রাজ্য স্থাপন করলো। এত বিরাট যে, এখনো তার না অনুসারে সে রাজ্যকে বলা হয় পেলোপনেসি- অর্থাৎ পেলপসের দীপ। তবু বংশের দিক থেকে সে খুব সৌভাগ্যবান ছিল না।  অবশ্য তার ছেলেমেয়েদের ভয়ঙ্কর রেষারেষি ও দানবীয় কীর্তিকলাপ তাকে দেখে যেতে হয় নি। তার আগেই তার মৃত্যু হয়। 









তার ছেলেদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ছিল আট্রিউস। পেলপসের মৃত্যুর পর সেই এই বিশাল রাজ্যের উত্তারিধকারী হয়। কিন্তু তার ছোট ভাই থায়েসটিস ক্রমাগত তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র আটতে থাকে। আট্রিউসের স্ত্রীরর নাম ছিল ইরোপি। এদেরই দুই ছেলে বিখ্যাত আগামেমনন এবং মেনেলাউস। 



কিছুকাল পরে নিজের স্ত্রীর সঙ্গে থায়েসটিসকে অত্যাধিক মেলামেশা করতে দেখে ত্রুদ্ধ হয়ে আট্রিউস তার ভাই খায়েসটিসকে রাজ্য থেকে নির্বাসনে দেয়। কিন্তু কিছু দিন পরেই সে নির্বাসনের চেয়েও নষ্ঠুর এক প্রতিহিংসার পরিকল্পনা করে। সে এমন ভাব দেখাতে থাকে যেন সে আবার তার ভাইয়ের সঙ্গে ঝগড়াঝাটি মিটিয়ে ফেলতে চায় এবং সেই পূর্ণমিলন অনুষ্ঠানে উদযাপনের জন্য এক ভোজের আয়োজন করে সেখানে ভাইকেও নিমন্ত্রণ করে। আট্রিউসের দুরভিসন্ধি বুঝতে না পেরে থায়েসটিকে সেই ভিজসভায় আসে।  








ভোজসভায় দুই ভাই এমনভাবে কথাবার্তা বলতে থাকে তারা আবার বন্ধু হয়ে উঠেছে। কিন্তু ভোজের সময় আট্রিউস একজন চাকরকে ডেকে থালাটা থায়েসটিসকে দেখতে বলে, যেটাতে করে থায়েসটিস একমাত্র খাচ্ছিল।


 থায়েসটিস দেখলো থালাটাতে করে যে মাংস খেয়েছে তা মানুষের মাংস। সে দেখে ভয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেল। আসলে থায়েসটিসেরই ছেলেমেয়েগুলোকে কেটে রান্না করে আট্রিউস তাকে খেতে দিয়েছে। শোনা যায় মানুষের এই ভয়ঙ্কর, বীভৎস ও নিষ্ঠুর আচরণ দেখে সূর্যও নাকি ঘৃনায় মুখ ফিরিয়ে উলটোদিকে চলতে শুরু করেছিল। 







থায়েসটিস যখন বুঝতে পারল, তখন সে লাফিয়ে উঠে লাথি মেরে খাওয়ার টেবিল উল্টে দিল, চলে যাওয়ার আগে সে অভিশাপ দিয়ে গেলো, এই আট্রিউস বংশে নিদারুন অভিশাপ নেমে আসবে। দেবতাদের কাছে সে প্রার্থনা করল তার সন্তারদের রক্তের মূল্য যেন আট্রিউসের সন্তারদের রক্ত দিয়ে শোধ করতে হয়, বিশ্বাসঘাতকতাই যেন বিশ্বাসঘাতকার প্রতিশোধ নেয়। 

মাইসিনির রাজপ্রাসাদে যে পাপ সংঘটিত হল, প্রাসাদের পাথরগুলো যেন সেই পাপের স্মৃতি ধারণ করে রাখে। এই বলে সে তার ভাইয়ের ভয়ে উত্তর গ্রিসে পালিয়ে গেল। সেখানে এক গোপন প্রণয়ের ফলে তার এক পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করে, তার নাম ইজিসথাস। পরবর্তীকালে এই ইজিসথাস আবার মাইসিনিতে ফিরে আসে। যদিও সে তার পিতার মতো কাপুরুষ ও ষড়যন্ত্রকারী ছিল, তবুও সেখানে ফিরে এসে সে আট্রিউসের সবচেয়ে খ্যাতনামা পুত্রদের এবং অন্যদের সর্বনাশ ডেকে আনতে সাহায্য করে। 








অবশ্য এসবই তখনো ভবিষ্যতের গর্ভে নিহিত। বাকি জীবন আট্রিউস বেশ নিরাপদেই কাটিয়ে যায়, যদিও তার ভাইয়ের অভিশাপের ভয় তার মনে সর্বদাই ছিল। তার মৃত্যুর পর তার রাজ্যভার পরে আগামেমনন ও মেনেলাউসের উপর। আগামেমনন মাইসিনির রাজ্যভার গ্রহণ করে এবং গ্রিসের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ও ঐশ্বর্যশালী রাজা হয়ে বাস করতে থাকে। তার স্ত্রী ছিল গর্বিতা এবং সুন্দরী ক্লাইটেমনেস্ট্রা। শেষকালে আগামেমননের চরম গৌরবের মুহূর্তে, এই রানী তার সঙ্গে কর্ম বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। 







আর স্বর্ণকেশী মেনেলাউসের রাজ্য ছিল ইউরোটাস নদীর তীরে অবস্থিত স্পার্টা। সেখানে সে তার স্ত্রী হেলেনকে নিয়ে বাস করত। এই স্পার্টাতেই প্যারিস আসে তার নৌবহর নিয়ে। 




আরো পড়ুন :







Post a Comment