বাংলা সালতানাত:আবিসিনীয়  শাসন আমল (১৪৮৭-১৪৯৩ সাল)

বাংলা সালতানাত : আবিসিনীয়  শাসন আমল






অবিসিনীয় শাসনামলকে ঐতিহাসিকেরা 'হাবশী শাসনামল'ই বলে থাকেন। আমাদের ধারণায় 'হাবশী' শব্দটায় ক্রীতদাসের কথা বেশি ব্যাক্ত হয়। অথচ এই 'ক্রীতদাস' কথাটি ওই সময়ে ঠিক ' অর্থে কেনা চাকর' অর্থে  সবসময় ব্যবহৃত হতো না। যুদ্ধবন্দী অথবা ভাগ্যাহত অনেককেই এই সুলতানের আশ্রয় দিতেন ,সুযোগ-সুবিধা দিতেন এবং প্রশাসনের বিভিন্ন দায়িত্ব প্রদান করতেন। আমীরের উচ্চপদও তারা লাভ করতেন। এই কথাটি স্মরণে রেখেই 'হাবশী 'শাসনামল'কে আমরা 'আবীসিনিয় শাসনামল ' বলেছি। 





শ্রী মুখোপাধ্যায়ের কথায় ,''বাংলার হাবশী সুলতানদের রাজত্ব সম্বন্ধে প্রায় সকলেরই মনে অত্যান্ত বিরূপ ধারণা আছে। এ সম্বন্ধে স্পষ্ট তথ্য হয়তো অনেকেরই জানা নেই ,কিন্তু হাবশী আমল যে অরাজকতা ও নৃশংসতায় পরিপূর্ণ এবং হাবশী রাজারা যে নিতান্ত অযোগ্য ,স্বেচ্ছাচারী এবং নিষ্ঠুর ছিলেন,,সে সম্বন্ধে কারো মধ্যে দ্বিমত দেখা যায় না। 



অনেক আধুনিক ঐতিহাসিক সমস্ত তথ্য এবং প্রমান খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ না করে নিতান্ত কতকগুলি গালগল্পের উপর নির্ভর করে হাবশীদের রাজত্ব সংক্রান্ত অধ্যায়টি লিপিবদ্ধ করেছেন এবং তার উপর নিজেদের উত্তপ্ত ধিক্কারবানী বর্ষণ করে সাধারণ পাঠকদের বিভ্রান্ত করেছেন। 



প্রথমে কুশাসনের প্রশ্নটি বিচার করা যাক। আধুনিক ঐতিহাসিকেরা 'হাবশী রাজা 'হিসাবে চারজন রাজার নাম উল্লেখ করেন। এরা সকলে মিলে প্রায় ছ'বছর রাজত্ব করেছিলেন। এর মধ্যে তিন বছর রাজত্ব করেন সৈফুদ্দিন ফিরোজ শাহ -যিনি বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ  সুলতানদের মধ্যে অন্যতম।


ঐতিহাসিকেরা যারা মহত্ত্ব ,যোগ্যতা ,বদান্যতা প্রভৃতি গুনের উচ্ছসিত প্রশংসা করেছেন। এক বছর রাজত্ব করেন কুতুব উদ্দিন মাহমুদ শাহ। এর রাজত্বকালেও কোন কুশাসন হয়েছিল বলে কোথাও লেখা নেই। কুশাসনের যা কিছু অভিযোগ তা অপর দু'জন রাজার সম্বন্ধেই সীমাবদ্ধ।এরা হলেন চারজনের মধ্যে প্রথম রাজা 'সুলতান শাহজাদা ' এবং শেষ রাজা শামসুদ্দিন  মুজাফ্ফর  শাহ।কিন্তু এদের সম্বন্ধে পরবর্তী কালের বইগুলিতে যা লেখা আছে ,তা যে সবটা সত্য নয়,তা পরে দেখাচ্ছি। আর একটা কথা মনে রাখতে হবে ,এই দু' জন 'কুশাসক' সুলতানের মিলিত রাজত্বকাল দু' বছর নয়।  





'ক্রীতদাস' কথাটার উপর অনেক ঐতিহাসিকের বেশি গুরুত্ব দেওয়া প্রসঙ্গে শ্রী মুখোপাধ্যায় বলেন ,''অতীতে যে ক্রীতদাস ছিল ,সেও যে একদিন সুলতান হয়ে যোগ্যতার সঙ্গে রাজ্য শাসন করতে পারে,তা কুতুব উদ্দিন আইবক ,ইলতুৎমিশ এবং বলবনের দৃষ্টান্ত থেকেই তো দেখতে পাওয়া যায়। এই নতুন ক্ষমতাধারীরা হাবশী বলেই যে অযোগ্য হবেন ,তা মনে করার কি কারণ আছে। 


সুলতান শাহজাদা বারবক শাহ (মাস ছ'য়েকের মত )



সুলতান ফতেহ শাহকে হত্যা করে খোঁজা বারবক সুলতান শাহজাদা উপাধি গ্রহণ করে বাংলার মসনদে আসীন হন। রাজ্যের প্রধান আমীর ও রাজপুরুষেরা ফতেহ শাহ হত্যাকারী এই  খোঁজা সুলতানকে মোটেও পছন্দ করতেন না। 


পছন্দ না করার আরও একটি কারণ হলো ,সুলতান শাহজাদা ছিলেন অত্যাচারী ও নিচ  প্রকৃতির মানুষ। ফলে দরবারে প্রধান ব্যক্তিরা সুলতান শাহজাদাকে বিতাড়িত করতে মনস্থ করলেন। এই প্রধান ব্যক্তিদের অন্যতম ছিলেন আবীসিনিয় আমীর মালিক আন্দিল। ফতেহ শাহ এর নিহত হওয়ার সময় মালিক আন্দিল সীমান্ত রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। খবর শুনে তিনি সুলতান শাহজাদাকে শাস্তি দেবার জন্য রাজধানীতে আসার উপায় চিন্তা করতে লাগলেন।


 এমন সময় সুলতান শাহ্জাদাই তাকে রাজধানীতে ডেকে পাঠালেন। মালিক আন্দিল রাজধানীতে পৌঁছে বুঝতে পারলেন যে,দরবারের অনেকেই চান সুলতান শাহজাদার অপসারণ। তারপর অল্পদিনের মধ্যেই মালিক আন্দিলের জন্য সুযোগ এসে গেল। তিনি সুলতান শাহজাদাকে হত্যা  করে বাংলার মসনদে আরোহন করলেন। 





সুলতান সাইফ-উদ-দীন ফিরোজ শাহ (১৪৮৭-১৪৯০ সাল )



ঐতিহাসিকদের মতে মালিক আন্দিল সাইফ-উদ -দীন ফিরোজ উপাধি গ্রহণ করে বাংলার মসনদে আরোহন করেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় ,সুলতান ফতেহ শাহর রাজত্বকালেই মালিক আন্দিল সুলতানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে 'বিরল 'অঞ্চলে স্বাধীনতার পতাকা উড়িয়েছিলেন। সেখানে তখন তিনি নিজ নামে শিলালিপি-মুদ্রা উৎকীর্ণ করেছিলেন। ''সৈফুদ্দিন ফিরোজ শাহ এর রাজত্বকালকে দুটি সুনির্দিষ্ট অধ্যায়ে বিভক্ত করা যেতে পারে।


 প্রথম অধ্যায়টি ৮৮৭ থেকে ৮৯৩ হিজরা অবধি বিস্তৃত ; তার এই অধ্যায়ের ৮৮৭ হিজরার শিলালিপি এবং ৮৯২ হিজরার মুদ্রা পাওয়া গেছে। এই অধ্যায়ে ফিরোজ শাহ উত্তরবঙ্গের এক ছোট অঞ্চলে (বিরল অঞ্চলে-লেখক )স্বাধীনভাবে রাজত্ব করেছিলেন ;বাংলার অবশিষ্ট অংশে রাজত্ব করেছিলেন জালালুদ্দীন ফতেহ শাহ। দ্বিতীয় অধ্যায়টির পরিব্যাপ্তিকাল ৮৯৩-৮৯৬ হিজরা। 


তার এই অধ্যায়ের ৮৯৩ হিজরার মুদ্রা এবং ৮৯৪,৮৯৫ ও ৮৯৬ হিজরার শিলালিপি পাওয়া গেছে। এই অধ্যায়ে তিনি সারা বাংলার একচ্ছত্র অধিপতি ছিলেন। সৈফুদ্দিন ফিরোজ শাহ একজন সত্যিকার কুশলী ব্যক্তি ছিলেন। যেভাবে তিনি সুলতান শাহজাদাকে বধ করেছিলেন ,তার থেকে তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধির পরিচয় মেলে। জালালুদ্দীন ফতেহ শাহ এর বিরুদ্ধে তিনি যে বিদ্রোহ করেছিলেন ,তার দরুন কেউ  কেউ তাকে বিশ্বাসহন্তা  বলতে পারেন। কিন্তু আত্মরক্ষার অনুরোধেই ফিরোজ শাহ এই বিদ্রোহ করেছিলেন। সুতরাং এতে তার কোনো অপরাধ হয়নি। 



সুলতান সাইফ-উদ-দীন ফিরোজ শাহ (ভূতপূর্ব মালিক আন্দিল )ছিলেন ন্যায়পরায়ণ ও উদার। জনসাধারণের শান্তি ও স্বাচ্ছন্দ্য বিধানে তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। একাধারে তার বীরত্ব ও মহত্বের জন্য সৈন্যরা ও জনসাধারণ তাকে যেমন ভক্তি করত,তেমন ভয়ও করত। 'রিয়াজ ' বর্ণিত বিবরণী অনুযায়ী উদারতা ও মহত্ত্বের দিক দিয়ে তার তুলনা হয় না। তার আগের রাজারা অনেক কষ্ট করে যেসব ধনদৌলত সঞ্চয় করেছিলেন,সেগুলো তিনি অল্প সময়ের মধ্যেই গরিবদের দান করে দিলেন। কথিত আছে ,তিনি একদিনেই এক লক্ষ টাকা গরিবদের দান করেছিলেন।



 তার সচিবেরা এই মুক্তহস্ত দান পছন্দ করেনি। নিজেদের মধ্যে তারা বলাবলি করতে লাগলো,'এই হাবশী বিনা কষ্টে ও পরিশ্রমে যে টাকার মালিক হয়েছে তার মূল্য বুঝতে পারছেন না। যাতে পারেন ,সেরকম কোন উপায় আমাদের বের করতে হবে। তাহলে ইনি আর এরকম যথেচ্ছাভাবে মুক্তহস্তে দান করতে পারবেন না। এই ঠিক করে তারা এক লাখ টাকা ঘরের মেঝেতে রেখে দিল,যাতে রাজা নিজের চোখে তা দেখে এবং তার মূল্য বোঝে তার উপর গুরুত্ব আরোপ করতে পারেন।


 রাজা যখন এই টাকা দেখলেন ,তখন তিনি জিজ্ঞাসা করলেন 'টাকাটা এখানে পরে আছে কেন ?'সচিবেরা বললেন এতো টাকাই আপনি গরিবদের দিতে বলেছেন। রাজা বলল,এতো কম টাকায় কি করে কুলোবে ?এর সঙ্গে আরও এক লাখ টাকা যোগ করো। সচিবেরা এতে অপ্রস্তুত হয়ে সব টাকা ভিখারিদের মাঝে বন্টন করে দিলেন। গল্পটি যদি অক্ষরে অক্ষরে সত্য না-ও হয় ,তাহলে ফিরোজ শাহ যে মহৎ দানবীর ছিলেন ,তা এর থেকে বোঝা যায়। কারণ সম্পূর্ণ বিনা কারণে কারও নামে এরকম গল্প রটে না। সুলতান সাইফ-উদ-দীন ফিরোজ শাহ গৌড়ে একটি মসজিদ ,একটি মিনার ও কটি জলাধার নির্মাণ করিয়েছিলেন। কিন্তু এই মহৎ সুলতানও আততায়ীর হাতে বরণ করেছিলেন নির্মম মৃত্যু। 


সুলতান নাসির-উদ-দীন মাহমুদ (দ্বিতীয় )শাহ (১৪৯০-১৪৯১ সাল )



তাবকাত -ই-আকবরী ,তারিখ-ই-ফিরিশতা এবং রিয়াজ-উস-সালাতীন অনুসারে সুলতান সাইফ-উদ-দীন ফিরোজ শাহ এর মৃত্যুর পর তার জ্যেষ্ঠ পুত্র মাহমুদ শাহ বাংলার মসনদে আরোহন করেন। তার উপাধি হয় সুলতান দ্বিতীয় নাসির-উদ-দীন মাহমুদ শাহ। ফিরিশতা ও 'রিয়াজ '- এর মতে সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদ শাহ এর রাজত্বকালে হাবশ খান নামে একজন হাবশী রাজকোষ ও শাসন ব্যবস্থার সর্বময় কর্তা হয়ে ওঠে।

 সুলতান হয়ে পড়েন হাবশ খানের হাতের পুতুল। কিছুদিন পর এই হাবশ খানকে হত্যা করে সিদি বদর নামে অন্য এক আবীসিনিয় উচ্চাকাঙ্ক্ষী নিজেই শাসন ব্যবস্থার কর্তা হয়ে বসে। অতঃপর সুলতানকে হত্যা করে সিদি বদর দখল  করে নেয় বাংলার মসনদ। তার উপাধি হয় সুলতান শামস-উদ-দীন মুজাফ্ফর শাহ। 


সুলতান শামস-উদ-দীন মুজাফ্ফর শাহ (১৪৯১-১৪৯৩ সাল )



সুলতান মাহমুদ শাহ এর হত্যাকারী সিদি বদর (সুলতান শামস-উদ-দীন মুজাফ্ফর শাহ )ছিলেন নিষ্ঠুর প্রকৃতির লোক এবং নিজের খেয়ালখুশি চরিতার্থ করার ব্যাপারে অত্যান্ত বেপরোয়া। ''রাজা হয়ে তিনি বহু শিক্ষিত ,ধার্মিক ও সম্ভ্রান্ত লোককে হত্যা করেন এবং হিন্দু রাজাদের যমালয়ে প্রেরণ করেন। অবশেষে তার অত্যচার যখন চরমে পৌছালো তখন সকলেই তার বিরুদ্ধে দাঁড়ালো। তার মন্ত্রী সৈয়দ হোসেন বিরুদ্ধবাদীদের নেতৃত্ব গ্রহণ করলেন এবং মুজাফ্ফর শাহ কে বধ করে নিজে রাজা হলেন। 



তার মৃত্যুর সঙ্গে আবীসিনিয় শাসনের অবসান হয়। এবার রাজনৈতিক মঞ্চের প্রধান চরিত্র হয়ে আবির্ভুত হন সৈয়দ হোসেন বা সৈয়দ আলা -উদ-দীন হোসেন। তিনিই ইতিহাসের সেই বিখ্যাত পুরুষ আলা-উদ-দীন হোসেন শাহ ,বাংলায় হোসেন শাহী রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। 



আরো পড়ুন :









Post a Comment