হোসেন শাহী আমল: সুলতান নাসিরুদ্দিন নসরত শাহ , সুলতান আলা-উদ-দীন ফিরোজ শাহ ও সুলতান গিয়াস-উদ-দীন মাহমুদ শাহ  



হোসেন শাহী আমল: শেষ তিন জন সুলতান এর আদ্যোপান্ত











স্বাধীনতার যুগে, এমন কি তুর্কী আমলেও বাংলার মুসলমান যে আরবি ভাষা ও সাহিত্যের অনুশীলন করিতেন, তাহার প্রমান ব্যাপক। বাংলার তুর্কী আমল হইতে স্বাধীনতার শেষ যুগ পর্যন্ত বাংলাদেশে যত মুসলিম শিলালিপি পাওয়া গিয়াছে, তাহার ভাষা আগাগোড়াই আরবী। মুসলমানদের ভাষা আরবী বলিয়া, জাতীয় সংস্কৃতির মূল বাহক ও ধারক হিসাবে এই ভাষার সহিত সোজাসুজি পরিচয় স্থাপন করা মুসলমানেরা নিশ্চয় শ্রেষ্ঠ ভাষাগত কর্তব্য বলিয়া মনে করিতেন। 


কেননা, তাহারা জানিতেন, বিদ্যাঅর্জন করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য ফরজ বা অবশ্যই কর্তব্য। বাঙালি মুসলমানের দেশীয় সাহিত্য রচনায় এই আরবী চর্চার প্রভাব দেখিতে পাওয়া যায়। বাংলা ভাষায় যে সমস্ত আরবী শব্দ প্রবেশ করিয়াছে, তাহা শুধু আদালতে ব্যবহৃত ফারসি ভাষার মধ্যস্থতায় ঘটে নাই, ইহা বাংলায় ব্যাপকভাবে আরবী ভাষা চর্চারও ফল। 



বাঙালি মুসলমানেরা এই স্বাধীনতার যুগে বাংলা ভাষায় ধর্মীয় সাহিত্যও সৃষ্টি করিয়াছেন। এই সাহিত্য আরবী ভাষার সহিত সোজাসুজি সংযোক স্থাপনেই সম্ভবপর হইয়াছিল। 



                সুলতান নাসির-উদ-দীন নসরত শাহ (১৫১৯-১৫৩১সাল) 

সুলতান হোসেন শাহর ১৮জন পুত্রের মধ্যে নসরত শাহই ছিলেন জ্যৈষ্ঠ। পিতার মৃত্যুর পর নসরত শাহ মসনদে সমাসীন হয়ে ভাইদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেন ও তাদের বৃত্তি দ্বিগুন করে দেন। সুলতান নসরত শাহর সময়েই এই উপমহাদেশের রাজনৈতিক আকাশে মুগল-সূর্য উদিত হয় যার ফলে রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে সংঘটিত হয় এক যুগান্তকারী পরিবর্তন। 

১৫২৬ সালে পানিপতের যুদ্ধে ইবরাহিম লোদীকে পরাস্ত করে বাবর এই উপমহাদেশের মুগল শক্তি প্রতিষ্ঠিত করেন। আফগানরা তখন দিল্লি-আগ্রা ছেড়ে পালিয়ে যেতে আরম্ভ করে। অনেকে লোহানী ও ফর্মুলীদের আশ্রয়ে চলে আসে, অনেকে আবার বাংলায় এসে নসরত শাহর আশ্রয় নেয়। 


এসবের পরিণতিতে এবং খরিদ নামক এক গুরুত্বপূর্ণ স্থানের অবাধ ব্যবহার নিয়ে মুঘল সম্রাট বাবরের সঙ্গে সুলতান নসরত শাহর মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। নসরত শাহ অত্যন্ত বিজ্ঞ রাজনীতিজ্ঞের মত সেই সংঘর্ষ এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। 


তবুও যুদ্ধ বেঁধে যায় এবং নসরত শাহর সৈন্যরা হেরে যায়। কিন্তু যেহেতু পাঠানদের শক্তিহীন করে ছিল বাবরের লক্ষ্য, নসরত শাহ নয়, তাই শেষ পর্যন্ত বাবর নসরত শাহর সঙ্গে শান্তি স্থাপন করেন।  



সম্রাট বাবরের মৃত্যুর পরে নসরত শাহ সংবাদ পান যে, বাদশা হুমায়ুন বাংলা আক্রমণের পরিকল্পনা করছেন। তখন নসরত শাহ গুজরাটের সুলতান বাহাদুর শাহর নিকট দূত পাঠিয়ে তার কাছ থেকে বাদশা হুমায়ুনের বিরোধিতা কামনা করেন। সুলতান বাহাদুর শাহও এতে উৎসাহ দেখান। কিন্তু কোনো চুক্তি সম্পাদনের আগেই নসরত শাহ ইন্তেকাল করেন। 




সুলতান নাসির-উদ-দীন নসরত শাহ ছিলেন অত্যন্ত যোগ্য শাসক। পিতার রাজ্যসীমা তিনি শুধু অক্ষুণ্লই রাখেন  নি, কোন কোন দিকে তা বর্ধিত করেন। সুলতান হোসেন শাহর সময়ে রাজ্যের পশ্চিম সীমা বিহারের কিছু অংশ সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু নসরত শাহ তা সপ্রসারিত করে বর্তমান উত্তর প্রদেশে বালিয়া জেলাস্থ খরিদ এলাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি করেন। তবুপরি তিনি ছিলেন উচ্চস্তরের এক কূটনীতিজ্ঞ। 





একজন নিষ্টাবান মুসলমান হিসাবে তিনি নির্মাণ করেন অনেক মসজিদ, যার কারুকার্য এদেশের স্থাপত্য শিল্পে রেখেছে উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। সুলতান নসরত শাহ গৌড়ের কদম রসুন ভবনে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের পবিত্র পদচিন্হ উৎকীর্ণ এক খানা পাথর স্থাপন করেন।


 ফলে এই ভবনটি পরিচিত হয় কদম রসূল ভবন নামে এবং তা মুসলমান সমাজে বিশেষভাবে আদৃত হয়। নসরত শাহ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পৃষ্টপোষকতার জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন। শ্রীকর নদীর মহাভারতে সুলতান হোসেন শাহর নামের সঙ্গে নসরত শাহর নামও উল্লেখ করা হয়েছে। 



কবি শেখর বা কবিরঞ্জ বা বিদ্যাপতি নামক একজন পদকর্তার ভণিতায়ও নসরত শাহর নাম পাওয়া যায়। প্রায় ১৩ বছর কৃতিত্বের সঙ্গে রাজত্ব করার পর সম্ভবত তিনি কোন আততায়ী কর্তৃক নিহত হন ১৫৩১/৩২ সালে। 




                সুলতান আলা-উদ-দীন ফিরোজ শাহ (১৫৩২-১৫৩৩ সাল

সুলতান নসরত শাহর মৃত্যুর পর বাংলার মসনদে সমাসীন হন সুলতান আলা-উদ-দীন ফিরোজ শাহ। কিন্তু অল্পদিন পরেই তার চাচা মাহমুদ শাহর চক্রান্তে নিহত হন। কিন্তু এই স্বল্পকালের মধ্যেই তিনি খান্দানের সাহিত্য ও সংস্কৃতি প্রীতির পরিচয় দিতে আরম্ভ করেছিলেন। তার আদেশে দ্বিজ শ্রীধর বিদ্যাসুন্দর কাব্য বা কালিকা মঙ্গল রচনা করেন। 




    সুলতান গিয়াস-উদ-দীন মাহমুদ শাহ (১৫৩৩-১৫৩৮ সাল)

স্বীয় ভ্রাতুষ্পুত্রকে হত্যা করে মসনদে আরোহন করতে গিয়ে উচ্চাভিলাষী মাহমুদ শাহ গোড়াতেই অমাত্যদের মধ্যে নিজের শত্রু সৃষ্টি করেন। এবং রাজ্যে অন্তর্বিরোধের বীজ বপন করেন। রিয়াজ-উদ-সালাতীনে বলা হয়েছে যে, মাহমুদ শাহর এই ঘৃণিত কাজের জন্য তারই নিকট-আত্মীয় ও হাজিপুরের শাসক মাখদুম আলম নতুন সুলতানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। 

মখদুম আলম বিহারের শাসনকর্তা জালাল খানের অভিবাবক শের খানের সঙ্গে মিত্রতা করার ফলে মাহমুদ শাহর বিরুদ্ধে শের খানও এগিয়ে আসেন। এই বিবাদের শেষ পরিণতি স্বরূপ শের খানের হাতে মাহমুদ শাহ পরাজিত হন এবং এই সঙ্গে বিলুপ্ত হয় হোসেন শাহী খান্দানের রাজ্য শাসন। ১৫৩৮ সালে পাঠান বীর শের খান বাংলা জয় করেন। দু'শ বছরের স্বাধীনতা হারিয়ে বাংলা আবার অধীনতা বরণ করে। 





আরো পড়ুন :














Post a Comment