কররানীর রাজবংশ: দাউদ খান কররানী (১৫৭২-১৫৭৬ সাল) 



বাংলা সালতানাত: কররানীর রাজবংশের শাসনামল । পর্ব ০২






এখানে যে কথাটি বলে নেয়া প্রয়োজন মনে করছি, তা হচ্ছে এই : মুসলিম সম্রাজ্য প্রধানের উপাধি ছিল তখন 'খলিফা', আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের বেলায় 'বাগদাদের খলিফা'। তার প্রতি আনুগত্যশীল বিভিন্ন রাজ্যের প্রধানগণের উপাধি ছিল 'সুলতান' অনেকটাই গভর্নরের মত। অধিকন্তু, মুঘলরাই ভারত বিজয়ের পর উপরিউক্ত ওই রীতির অবসান ঘটায়। দিল্লী-কেন্দ্রিক সর্বোচ্চ মুঘল শাসকের উপাধি হল খলিফার বদলে বাদশা বাদশাহ শাহান শাহ। 


                                 দাউদ খান কররানির ইতিকথা 

সুলায়মান খান কররানীর মৃত্যুর পর বাংলা-বিহারের তদানীন্তন রাজধানী তান্ডায় যে আত্নঘাতী দলাদলী আরম্ভ হয়, তার পরিণামে দাউদ খান কররানীর রাজত্বকালে দেখা দেয় এক সর্বনাশা বিশৃঙ্খলা ও মতবিরোধ। আর তারই সুযোগ গ্রহণ করেন মুগল সম্রাট আকবর।  




বায়েজিদ খান কররানীকে হত্যা করে সাময়িককভাবে মসনদ দখল করে যে হাসু, তার পক্ষাবলম্বী আফগানদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন লোহানীদের সর্বদা কতলু খান লোহানী। উজীর লোদী খান হাসুকে হত্যা করিয়ে দাউদ খান কররানীকে মসনদে বসানোর পর কতলু খান  লোহানী তার  অনুচরনরন্দসহ দাউদ খানের নিকট আত্নসমর্পন করেন।

 কিন্তু  ওদিকে গুজৱ খান কররানী নামক পাঠান-প্রধান বায়েজীদ খানের এক  এক ছেলেকে বিহারের মসনদে বসিয়ে দেন। আফগানদের মধ্যে যখনি এমনি পরিস্থিতি বিরাজমান, সম্রাট আকবর তখন সেনাপতি মুনিম খান  খান-ই খানাকে বাংলা  বিহার রাজ্য আক্রমণ করতে পাঠান। 

এর আজব দাউদ খান কররানী মসনদে আরোহণ করে সম্রাট আকবরের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন নি। অধিকন্তু তিনি নিজ নামে খুৎবা পাঠ ও মুদ্রা জারির ব্যবস্থা করেন। বেশ অত্যাচারী-অনাচারিও হয়ে ওঠেন তিনি। ফলে রাজ্যের আমিরগণ হয়ে ওঠেন অতিষ্ঠ। এমনি অবস্থায় সম্রাট আকবর বাংলা-বিহার আক্রমণের জন্য মুনিম খানকে পাঠান। মুনিম খান চুনার থেকে পাটনার দিকে অগ্রসর হন এবং বাংলা আক্রমণের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন।


 এমনি অবস্থায় উজীর লোদী খান মুনিম খানের অভিযানের গুরুত্ব অনুধাবন করে গুজর খান কররানীর সঙ্গে মিত্রতা  স্থাপন করেন এবং প্রচুর উপঢৌকনের বিনিময়ে মুনিম খানকে ফিরিয়ে দিতে সমর্থন হন। এভাবে লোদী খান  প্রথম বিপদ কাটিয়ে ওঠেন। 


ইতিমধ্যে মুগল এলাকা গোরক্ষপুরে বিদ্রোহ দেখা দেয় এবং মুনিম খান সেই বিদ্রোহ দমনে  ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে পড়েন। আর এটাকে সুবর্ণ সুযোগ মনে করে দাউদ খান কররানী কালাপাহাড়ের সহায়তায় জৌনপুর আক্রমণ করে বসেন। 


বিশ্ব সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে জানতে ঘুরে আসুন  বাংলার পাঁচ মুক্ত সাহিত্যকোষ থেকে  


মুনিম খান লোদী খানের সঙ্গে সন্ধি  করতে বাধ্য হন। এ সময় কতলু খান লোহানী দাউদ কররানীকে বোঝালেন যে, লোদী খান তার ভাবি জামাতা তাজ খান ইউসুফকে  হত্যা করান। এতে  হতাশ হয়ে লোদী খান দাউদ খানের  বিরুদ্ধে সৈন্য পরিচালনা করলেন। কালাপাহাড় লোদী খানের সঙ্গে যোগ দিতে অস্বীকার করায় লোদী খান মুনিম খানের সাহায্য কামনা করে রোহতাস দুর্গে আশ্রয় নেন। 




সম্রাট আকবর বাংলা জয়ের মানসে এবার রাজা তোডরমলকে মুনিম খানের সঙ্গে যোগ দিতে পাঠান। নবোদ্যমে মুনিম খান দাউদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। এবার উপায় না দেখে দাউদ খান আফগান স্বার্থ রক্ষায় লোদী খানকে এগিয়ে আস্তে অনুরোধ পাঠান। যদি খানের কাছে নিজ স্বার্থের চেয়ে জাতীয় স্বার্থের আবেদন ছিল অধিকতর কার্যকর। ফলে, দাউদ খানের কথা বিশ্বাস করে তিনি তার অনুরোধে সারা দেন। 

শোন  নদীর তীরে তিনি বাধা দেন মুগল বাহিনীকে। মুগল অগ্রগতি বন্ধ হয়ে গেল। মুনিম খানের সঙ্গে সন্ধি হলো লোদী খানের। সুপ্রসন্ন হয়ে উঠল দাউদ খানের ভাগ্য। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীদের চক্রান্ত ভুল করলেন দাউদ খান। কতলু খান লোহানী, গুজর খান প্রমুখ আফগান-প্রধান লোদী খানের বিরুদ্ধে দাউদ খান কররানীর কান বিষিয়ে তোললেন। দাউদ খান কররানী এবার লোদী খানকে প্রথমে বন্দি করে পরে হত্যা করেন।   



লোদী খানের মৃত্যুর পর আফগানদের মধ্যে দেখা দেয় চরম বিশৃঙ্খলা। দাউদ খানের অমাত্যদের মধ্যে এমন কেও ছিলেন না, যিনি এই বিশৃঙ্খলা দূর করতে পারেন। এই সুযোগে মুনিম খান আবার ছুতে এলেন বাংলার পথে। শোন নদী অতিক্রম করে পাটনার পথে অগ্রসর হলেন মুনিম খান; আর অনেক সৈন্য-সামন্ত থাকা সত্বেও দাউদ খান কররানী আশ্রয় নিলেন পাটনা দুর্গে। 


১৫৭৩ সালের শেষ দিকে পাটনার দুর্গ অবরোধ করলেন মুনিম খান। অবরোধ চললো বহুদিন। ১৫৭৪ সালে সম্রাট আকবর নিজে এলেন পাটনা অবরোধ তদারক করতে। পরিস্থিতি অনুধাবন করে সম্রাট আকবর পাটনা দুর্গের রসদ-সূত্র হাজীপুর জয় করার হুমকি দিলেন। প্রথম আক্রমণেই হাজীপুর চলে আসে মুগল অধিকারে। চরম হতাশা ও বিশৃংখলার মধ্যে দাউদ খান ও আফগান-প্রধানেরা পালালেন পাটনা দুর্গ থেকে। বিহার থেকে বিতাড়িত হলেন দাউদ খান কররানী। 

এবার আরম্ভ হয় দাউদ খান কররানীর পতনের শেষ পর্যায়। এই পর্যায়ে আছে দাউদ খানের সেনানায়ক ও অমাত্যদের বিচ্ছিন্নভাবে বিশাল বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা রাজ্যের নানা স্থানে অবস্থান গ্রহণ, মুগলদের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজয় বরণ ও পলায়ন। দাউদ খান কররানীর অবস্থায় ছিল তা-ই। এই সময়ের মধ্যে দু'টি সময় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার জন্য স্মরণীয় হয়ে আছে। ১৫৭৫ সালের ৩রা মার্চ উড়িষ্যায় আফগানদের সঙ্গে মুগলদের যুদ্ধ হয়।

 এই যুদ্ধে তুকারায়ের যুদ্ধ বা মুগলমারির যুদ্ধ নামে খ্যাত। তুকারায় ও মুগলমারি মেদিনীপুর জেলায় দুটি গ্রামের মধ্যে ব্যাবধান ৮মাইল। এই ৮ মাইল বিস্তৃত স্থানেই সংঘটিত হয় এই যুদ্ধ। বাংলার ইতিহাসে এই যুদ্ধ গুরুত্বপূর্ণ এজন্য যে, এ যুদ্ধেই আফগানরা দেশের মিয়ন্ত্রন পুরোপুরি হারিয়ে ফেলে এবং বাংলায় আফগান স্বাধীনতার অবসান ঘটে। 


আর ১৫৭৬ সালের ১২ জুলাই সংঘটিত হয় রাজমহলের যুদ্ধ। এই যুদ্ধে মুগল সেনাপতি ছিলেন খানই-জাহান। আর আফগানদের নেতৃত্বে ছিলেন দাউদ খান কররানী। এ যুদ্ধেও বিজয়ী হয় মুগলবাহিনী। পালতে গিয়ে দাউদ খানের ঘোড়ার পা কাদায় আটকে যায়। বন্দি হন দাউদ খান কররানী। মুগল আমীরদের দাবি অনুসারে হত্যা করা হয় দাউদ খান কররানীকে। এই সঙ্গে লুপ্ত হয় বাংলায় আফগানদের স্বাধীন সালতানাত। 


আরো পড়ুন :












Post a Comment