বাংলা সালতানাত: কররানী রাজবংশের শাসনামল  




বাংলা সালতানাত: কররানী রাজবংশের শাসনামল







প্রাক-মুসলিম যুগের বাংলায় ব্যবসা-বাণিজ্যের অবনতি প্রসঙ্গে ডক্টর নীহাররঞ্জন রায়-এর মন্তব্য হচ্ছে: ''অষ্টম শতকের গোড়া থেকেই পূর্ব-ভূমধ্যেসাগর থেকে আরম্ভ করে প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত বৈদেশিক সামুদ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য আরব ও পারসিক বণিকদের হাতে চলে যেতে আরম্ভ করে।

 পশ্চিম ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্যের অন্যতম আশ্রয় সিন্ধুদেশ আরব বণিকদের দখলে চলে গেল। রোম সাম্রাজ্যের ধ্বংসের ফলে ভুমধ্যসাগরী ভূখণ্ডে ভারতীয় শিল্প ও গন্ধদ্রব্যের চাহিদাও গেল কমে। পূর্ব-ভারতে তাম্রলিপ্তি বন্দরও একাধিক কারণে বন্ধ হয়ে গেল।

এরপর পাঁচশত বছর ধরে সামুদ্রিক বাণিজ্যে বাংলা দেশের তেমন কোন স্থান নেই। কাজেই বাইরে থেকে সোনা-রুপার আমদানিও কম। স্বর্ণমুদ্রার অবনতির ভেতর দিয়ে এই দৈন্যের পরিচয় পাওয়া যায়। 




                       সুলতান তাজ খান কররানী (১৫৬৪-১৫৬৫ সাল) 

সুলতান তাজ খান কররানী বছর খানেকের মত বাংলা শাসন করেই মৃত্যুমুখে পতিত হন। বাংলার মসনদে বসেই তারই ভাই সুলায়মান খান কররানী। 






                                সুলায়মান খান কররানী (১৫৬৫-১৫৭২ সাল)


বাংলার শাসন কর্তৃত্ব গ্রহণের আগেই সুলায়মান কররানী ছিলেন বিহারের শাসনকর্তা। এবার বিহার ও বাংলা মিলিয়ে বিশাল ভূখণ্ডের শাসনকর্তৃত্বের অধিকারী হলেন তিনি। এদিকে সম্রাট আকবরের রাজত্বে মুগল সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটতে থাকে এবং তারই সঙ্গে সংকুচিত হতে থাকে এই উপমহাদেশের পাঠান কর্তৃত্ব। 

এমনি অবস্থায় সুলায়মান কররানী হয়ে ওঠেন পাঠান শক্তির ধারক ও বাহক। ইসলাম খান সূরের পরে সূরদের মধ্যে অন্তর্বিরোধ দেখা দেওয়ায় এবং মুগলদের হাতে পরাজয়ের পর উত্তর ভারতের সকল আফগান ছুতে আসতে থাকে তাদের শেষ ভরসাস্থল বাংলা-বিহারের পানে। 

সুলায়মান খান কররানী তাদেরকে চাকুরিসহ সকল সুবিধার বন্দোবস্ত করে দেন। তাতে করে সুলায়মান খানেরও শক্তি বৃদ্ধি হয়। ঐতিহাসিক স্টুয়ার্টের মতে, সুলায়মান খান কররানীর অধীনে গড়ে ওঠে ৩৬০০ হাতি, ৪০ হাজার অশ্বারোহী, ১৪ হাজার পদাতিক ও ২০ হাজার কামানের এক বিশাল বাহিনী। 



বিশ্ব সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে জানতে ঘুরে আসুন বাংলার পাঁচ মুক্ত সাহিত্যকোষ থেকে  



 সুলায়মান খান কররানী ছিলেন ধীরস্থির প্রকৃতির মানুষ এবং পররাষ্ট বিষয়ে এক বিচক্ষণ শাসক। তিনি উপলব্ধি করতে পারেন যে, হঠকারিতা দেখিয়ে পাঠানরা ক্রমবর্ধমান মুগল শক্তির বিরুদ্ধে টিকে থাকতে পারবে না।

 তাই তিনি মুগলদের সঙ্গে যথাযথ সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। বিভিন্ন সময়ে দিল্লীতে পাঠাতে থাকেন নানাবিধ উপহার সামগ্রী। সুলতান উপাধিও তিনি গ্রহণ করেন নাই। জৌনপুরের মুগল শাসনকর্তা খান-ই-জামানের সঙ্গেও তিনি গড়ে তোলেন বন্ধুত্বের সম্পর্ক। তার উদ্দেশ্য ছিল বাংলা-বিহারকে মুগলদের সম্প্রসারণ অভিযান থেকে বাঁচিয়ে রাখে। এ কাজে তিনি সফলও হয়েছিলেন। 


এর মধ্যে উড়িষ্যার সঙ্গে সুলায়মান খান কররানী সংঘর্ষে জড়িত হয়ে পড়েছিলেন। উড়িষ্যার রাজা মুকুন্দ হরিচরণ জনৈক পলাতক ইবরাহিম খান সূরকে স্বরাজ্যের আশ্রয় দিয়ে সুলায়মান খান কররানীর সঙ্গে শত্রুতার সূচনা করেন। তাই তিনি শত্রুর বন্ধুর শত্রুর উড়িষ্যা রসাজেসকে সুলায়মানের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করেন। 

১৫৬৭ সালে সম্রাট আকবর যখন চিতোর আক্রমণে ব্যাস্ত, তখন সুলায়মান খান উড়িষ্যা আক্রমণের আদেশ দেন। উড়িষ্যা রাজা বীর বিক্রমকে যুদ্ধ করেও পরাজিত হন এবং পুরীসহ উড়িষ্যা জয় করে নেয় বাংলা বাহিনী। উড়িষ্যা বিজয়ের পর সুলায়মান খান কররানী লোদী খান ও কতলু খানকে যথাক্রমে উড়িষ্যা ও পুরীর শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। 



এরপর সুলায়মান খান জড়িয়ে পড়েন কোচবিহার রাজ্যের সঙ্গে এক অবাঞ্ছিত সংঘর্ষে। কোচবিহারের রাজা বিশ্বসিংহ কামতা রাজ্যে জয় করার পর রাজ্য বিস্তারের নেশায় মেতে ওঠেন। বিশ্বসিংহের পুত্ররা রাজ্যের আরো বিস্তৃতি ঘটান। ১৫৬৮ সালে কোচবিহার বাহিনী সুলায়মান খানের রাজ্য সীমান্তে এসে হানা দেয়। ফলে বাংলা বাহিনী কোচবিহার আক্রমণ করে। কিন্তু বিজয়ী হয়েও সুলায়মান খান কররানী কোচবিহার থেকে ফিরিয়ে আনেন তার বাহিনীকে। 

বন্ধুত্ব স্থাপন করেন কোচবিহার রাজের সঙ্গে। ইটা সুলায়মান খানের দূরদর্শিতার আরেক প্রমান। তিনি বুঝতে পারেন শক্তিশালী মুগলদের সঙ্গে তার সংঘর্ষ অনিবার্য। তাই শত্রুর সংখ্যা তিনি কিছুতেই বাড়াতে পারেন না। সুলায়মান খান কররানীর এসব কৃতিত্বের পেছনে ছিল তার বিচক্ষণ উজীর লোদী খানের উল্লেখযোগ্য অবদান। সাত বছর কৃতিত্বের সঙ্গে বাংলার-বিহার শাসন করে ১৫৭২ সালের ১১ অক্টোবর তারিখে ইন্তেকাল করেন এই কৃতি শাসক সুলায়মান খান কররানী। 

কিন্তু নিজের হঠকারিতার ফলে অল্পদিনের মধ্যেই তাকে হত্যা করে বসে সুলায়মান কররানীর জামাতা হাসুর নেতৃত্বে একদল লোহানী আফগান। কিন্তু উজীর লোদী খান হাসুর বিরুদ্ধাচারণ করেন এবং হাসুকে হত্যা করিয়ে সুলায়মান কররানীর কনিষ্ঠ পুত্র দাউদ খান কররানীকে মসনদে বসান। 



আরো পড়ুন :








Post a Comment