নবাব মীর কাসিম  

                             বিশ্বাসঘাতক নাকি দেশপ্রেমিক ছিলেন 


নবাব মীর কাসিম







পলাশীর যুদ্ধের ইতিহাস আমরা কম বেশি সবাই জানি। ইংরেজ দস্যুদল , মীর জাফর এবং কিছু বিশ্বাসঘাতক একত্র হয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। কিন্তু আজ আমরা জানবো মীর জাফর এর জামাতা মীর কাসিম ও কি বিশ্বাসঘাতক ছিলেন নাকি দেশ প্রেমিক ছিলেন। 




১৭৫৭ সালে পলাশীর ঐতিহাসিক যুদ্ধে নবাব সিরাজ উদ দৌলাকে পরাজিত ও হত্যা করার পর বিশ্বাসঘাতক মীর জাফর বাংলার মসনদে বসেন। তার বিলাসিতা ও ভোগসর্বস্ব প্রকৃতির কারণে অল্প দিনের মধ্যে বাংলায় অরাজকতা ও অসন্তুষ্টির মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। এই ভোগের খেলায় তার সাথে যোগ হয় তার পুত্র মিরন। দেশের প্রতি কোনো নজর না থাকায় এই দুই পিত পুত্রকে নিয়ে বিপাকে পড়েন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া সরকার। প্রথমে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মিরণকে হত্যা করে। তারপর দেশের বেহাল অবস্থা থাকে উত্তরণের জন্য মীর জাফরকে অপসারণ করে তার অবস্থান তার জামাতা মীর কাশিমকে ক্ষমতায় বসানো হয় ১৭৬০ সালে। 




নবাব মীর কাসিম









ইরাকের নাজাফের অভিজাত বংশীয় মীর রাজি খানের পুত্র মীর কাসিম। পুরো নাম মীর মোহাম্মদ কাসিম আলী খান। মীর জাফরের কন্যা ফাতিমা বেগমকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন তিনি। নবাব হিসেবে তার যোগ্যতার কোনো কমতি ছিলোনা। তিনি ছিলেন স্বধিনচেতা ও দেশপ্রেমিক। শশুরের মতো কাপুরুষ ও মেরুদ্বন্ধহীন ছিলেন না। দেশপ্রেমের ক্ষেত্রে তার কোনো দৈন্য তো ছিলোই না , বরং এই গুণটির যথেষ্ট আধিক্য ছিল। 





নবাব মীর কাসিম










মীর জাফর আর তার দুর্বৃত্ত পুত্র মিরনের দুশশাসন ও দুর্নীতির ফলে শাসনব্যবস্থায় অরাজকতা ও অর্থনীতিতে দেউলিয়াপনা দেশকে পেয়ে বসেছিল। কৃষকরা ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হতে থাকে,বকেয়া বেতনের দাবিতে সেনাবাহিনীর মধ্যে একের  পর এক বিপ্লব ঘটতে থাকে।এই অবস্থায় দেশটাকে দেখতে পেয়ে শিউরে ওঠেন নবনিযুক্ত নবাব মীর কাশিম। 


অবিলম্বে তিনি এমন সব ব্যাবস্থা গ্রহণ করেন যাতে কিছুন দিনের মধ্যেই দেশের অর্থনৈতিক ব্যাবস্থার প্রভূত উন্নয়ন সাধিত হয়। তার গৃহীত নীতি ছিল বেশ কঠোর। ফলে বেশ কিছু লোক,বিশেষ করে সুবিধাবাদী কিছু লোক বেশ অসুবিধায় পড়েন। মীর কাশিম দেশের অর্থনীতি কে মোটামুটি সুস্থ ভিত্তির উপর স্থাপন করে সামরিক শক্তি বৃদ্ধির কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি  সৈনিক দের বকেয়া বেতন পরিশোধ করেন এবং নিয়মিত বেতন পাবার ব্যবস্থা করি তাদের সঠিক শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করেন।



নবাব মীর কাসিম







নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার সাথে ইংরেজদের বিরোধের কারণগুলোর মধ্যে একটি বড় কারণ ছিলো ইংরেজদের দেয়া শুল্ক নিয়ে।১৭১৭  সালে ফররুখশিয়ারের আমলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বছরে মাত্র তিন হাজার রুপি প্রদানের শর্তে সমগ্র বাংলায় শুল্কমুক্ত বাণিজ্যের করবে,বাকি সব স্থানীয় বণিক কে যে আয়ের ৪০%হরে শুল্ক দিতে হবে। এই ব্যাবস্থা কে রাজকীয় দস্তক বলা হয়। 







সিরাজ তাদের স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন,নবাব মুর্শিদকুলি খান ইংরেজদের বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যে নিয়ম-নীতি নির্ধারন করে দিয়েছিলেন ,সেসব মেনেই তাদের এ দেশে বাণিজ্য করতে হবে। নইলে এ দেশে বাণিজ্যের আশা  ছেড়ে দিতে হবে।  ইংরেজরা তা মানতে রাজি  ছিলো না। উৎকোচ,উপহার,পেশকস ইত্যাদি দিয়ে নবাবকে হাতে রাখার পায়তারা করে আর অল্প শুল্ক প্রদান করে তারা এই দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থের হানি করে। এই বিরোধের জের ধরেই নবাব শুধু রাজ্য নয় প্রাণও হারান।


নবাব মীর কাসিম







নবাব মীর কাশিম সিংহাসনে বসে দেশের অর্থনীতির ভিত্তি মজবুত করতে গিয়ে দেখেন,ইংরেজরা সরকার কে ফাঁকি দিয়ে বিনা শুল্কে  অথবা অতি সামান্য শুল্ক প্রদানের মাধ্যমে এদেশে বাণিজ্য করে যাচ্ছে।ব্যাপার টা  শুধু সেখানেই শেষ নয়। নবাব লক্ষ্য করেন,ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তো  শুল্কের সব ফায়দা লুটছেই ,সেই সাথে ইংল্যান্ড থেকে আসা সাধারণ ব্যাবসায়ীরাও শুধু ইংরেজ বলে কোম্পানির ভোগকৃত সুবিধাসমূহ ভোগ করে যাচ্ছে।








নবাব মীর কাশিম এই দস্তক প্রথার পূর্ণ বিরোধিতা করেন। এ ব্যাপারে কোম্পানির সাথে আলোচনায় বসে বলেন ,ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ব্যাবসার সাথে সুযোগ সুবিধা ভোগ করছে ,তা তিনি  মেনে   নেবেন। কিন্তু কোম্পানির সদস্য ব্যাতিরেকে ইংল্যান্ড এর অন্য ব্যাবসায়ীদের নিয়ম মতো শুল্ক দিয়েই ব্যবসা করতে হবে। কিন্তু ইংরেজদের দাবি ছিল, সকল সকল ইংরেজ বণিক কে এই রকম সুবিধা দিতে হবে। 











সঙ্গত কারণেই নবাব তাতে সম্মত হতে পারলেন না।ব্যাবসায় একচেটিয়া অধিকার লাভের আশাতেই ইংরেজরা  পুরো একটা সম্রাজ্যের মূলোৎপাটন করে বসেছিলো।এমন স্বাধীনচেতা মনোভাব তারা কখনোই আশা করেন নাই। তারা সকল ইংরেজ বণিকদের জন্যই শুল্কমুক্ত বাণিজ্যের ধারা বজায় রাখতে চায়। ইংরেজদের সাথে মীমাংসায় ব্যার্থ হয়ে মীর কাসিম রেগে গিয়ে দেশে সকল প্রকার বণিকের শুল্ক প্রদানের ব্যবস্থা রহিত করেন। শুধু নিরহ বনিকেরাই শুল্ক দেবে,আর ইংরেজরা সব বিনা শুল্কে এদেশে বাণিজ্য করবে ,এমনটা তিনি মেনে নিতে চাননি। 






নবাব মীর কাসিম






ক্ষমতায় বসার অনতিকাল পরেই নবাব মীর কাশিম রাজধানী মুর্শিদাবাদ থেকে বিহারের মুঙ্গেরে স্থানান্তর করেছিলেন। সেখানে তিনি নিজের একটি স্বতন্ত্র সেনাবাহিনীও গড়ে  তোলেন। ইংরেজদের প্রভাবমুক্ত হওয়ার বাসনা তার গোড়া থেকেই ছিল। ইংরেজদের সাথে শুল্ক নিয়ে বিরোধের জের ধরে মীর কাশিমের জন্য একাধিক সশস্ত্র সংগ্রাম  অবধারিত হয়ে পরে। বিশ্বাসঘাতক মীর জাফর ও ইংরেজদের পক্ষ নিয়ে নিজ জামাতার বিরুদ্ধে  লড়াইয়ে যোগ দেন। 






যুদ্ধটা  শুরু করে প্রথমে  ইংরেজরাই। যুদ্ধ শুরু হয় আজিমাবাদ -পাটনায়। ইংরেজরা অতর্কিত আক্রমণ  করে পাটনা দখল করে নেয়। এরপরের যুদ্ধ হয় কোতোয়ায়। নবাব মীর কাশিম প্রতি টি যুদ্ধেই তার বিভিন্ন সেনাপতির অধীনে সৈন্য প্রেরণ করতেন।সেনাপতিদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে এবং ব্যাক্তিগত অহংকার  ও হিংসার কারণে যে যুদ্ধে মীর কাশিমের জয় সুনিশ্চিত বা ছিলো ,তাতে তিনি  পরাজয় বরণ করেন।সেই যুদ্ধেই তার সর্বনাশের সূচনা হয়। 







এরপরের  যুদ্ধ হয়  সুতি নামক  স্থানে। এই যুদ্ধেও মীর কাশিম নিজে  না গিয়ে  সেনাপতিদের পাঠান এবং এবং  সেনাপতিদের মতানৈক্যের কারণে নবাবের বিশাল  বাহিনী ইংরেজদের ক্ষুদ্র সেনা দলের  কাছে পরাজিত হয়। সুতির যুদ্ধে  পরাজিত হয়ে মীর কাশিম  তার  পরিবার-পরিজন ও ধন সম্পদ নিরাপত্তার জন্য দুর্ভেদ্য রোটাস  দুর্গে পাঠান। তিনি রাজমহলের কাছে উদয়নালা নামক একটি অতি সুরক্ষিত স্থানে তার  বিরাট সৈন্যদল নিয়ে ঘাঁটি স্থাপন  করেন। স্থানটি খুবই দুর্ভেদ্য  বলে বিবেচিত হওয়ায় তার সৈন্যরা ঘাঁটি প্রহরার কোনো ব্যবস্থাই করলো  না। 









নবাব মীর কাসিম




এই ঘাঁটি সংলঙ্গ  এক বিশাল জলাভূমির অপর তীরেই মীর জাফর কে সাথে  নিয়ে ইংরেজরা  শিবির স্থাপন করেছিলো। জলাভূমি অতিক্রম করার একটি গোপন পথের সন্ধান  পেয়ে ইংরেজদল একরাতে আক্রমণ করে মীর কাশিমের অপ্রস্তুত বাহিনীকে শোচনীয় ভাবে পরাজিত করে। অধিকাংশ সৈন্য  বিনা যুদ্ধে নিহত হয় এবং বিপুল পরিমান অস্ত্রশস্ত্র ইংরেজদের হস্তগত হয়। মিয়ার কাশিম কি করে রক্ষা পেয়েছিলেন তার সঠিক বর্ণনা পাওয়া যায়নি তবে তিনি পালিয়ে যেতে  সমর্থ হয়েছিলেন।



একেরপর এক যুদ্ধে হেরে যাওয়ায় মীর কাশিম বেশ নিরাশ হয়ে পড়েন। উদয়নালার যুদ্ধে  পরাজয়ের পর মীর কাশিম পটনার দিকে অগ্রসর হন। পথে খবর পান ইংরেজরা তার মুঙ্গের দুর্গ দখল করে নিয়েছে।পরিস্থিতি সহ্যসীমার বাইরে গেলে মীর কাশিম তার কাছে বন্দি থাকা সব ইংরেজকে হত্যা করেন। একমাত্র ইংরেজ ডাক্তার  ফুলারটন পালিয়ে ইংরেজ  শিবিরে আশ্রয় নেন। 


এরপর নবাব অযোধ্যার নবাব সুজা-উদ-দৌলার কাছে  সাহায্য চান। সুজা-উদ-দৌলা আর মুগল সম্রাট  ২য়  শাহ  আলম এর মিলিত বাহিনী  মীর কাশিম ইংরেজদের সাথে  যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। প্রথমে পাটনায় পরবর্তীতে ১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধে তিনি শোচনীয় ভাবে পরাজিত হন। শাহ আলম ও সুজা-উদ-দৌলার মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে এই জোট ভেঙে পড়ে। শাহ আলম যুদ্ধের এক পর্যায়ে  ইংরেজদের সাথে যোগ দেন। তিনজন মরিয়া হয়ে ওঠা মিত্রের মধ্যে মৌলিক সমন্বয়ের অভাবেই এই জোট ব্যর্থ হয়। বিভিন্ন সূত্রমতে ,ঐতিহাসিক বক্সারের যুদ্ধে এই তিন শাসকের মিলিত বাহিনীর  ৪০,০০০  সেনা ইংরেজদের মাত্র সেনার কাছে পরাজিত হয়। 











নবাব মীর কাসিম



মীর কাশিম কে কোনঠাসা করে ইংরেজরা পুনরায় মীর জাফর কে ক্ষমতায় বসায়। পরাজিত মীর কাশিমের ধন -সম্পদ  সব সুজা-উদ-দৌলা লুটে  নেন এবং তাকে একটি খোঁড়া হাতির পিঠে চাপিয়ে নির্বাসিত করেন। দুর্দশাগ্রস্ত  নবাব প্রথমে রোহিলাখন্ড  ,তারপর এলাহাবাদ , গোহাদ ,যোধপুর হয়ে দিল্লির নিকটে আবাস গড়েন। একেবারে অজ্ঞাতসারে এবং অতি দারিদ্রের মধ্যে তার মৃত্যু হয়। তার ছেড়ে যাওয়া সম্পত্তির  মধ্যে ছিল শুধু দুটি শাল , যেগুলো বিক্রি করে তার সৎকারের খরচ জোগাড় করা হয়। এই দেশপ্রেমিকের জীবনপ্রদীপ নেভার সাথে সাথে উপমহাদেশ থেকে ইংরেজ বিরোধী শেষ শিখাটাও নিভে যায়  .


বক্সারের  যুদ্ধের সাফল্য ইংরেজদের জন্য পলাশীর  যুদ্ধের সাফল্যের চেয়েও বড় ছিলো। তারা আরো বেশি শক্তপোক্ত হয়ে উপমহাদেশে ক্ষমতার পরিধি বিস্তার করতে  থাকে।স্পৃহা,সামর্থ্য বা দূরদর্শিতা কোনোটারই অভাব ছিল না মীর কাশিমের। হয়তো তার বিধিই বাম  ছিল। দেশ কে বিদেশী শোষণ  থেকে করার স্বপ্নদ্রষ্টা নিজেকে  একদিন আড়ালে ,পথসজ্জায়  হারিয়ে গেলেন। তবে ইতিহাসে তিনি আজও স্বাধীনতার এক অনন্য স্বপ্নদ্রষ্টা। 



You have to wait 60 seconds.













Post a Comment