বাংলা সালতানাত : বাংলায় সুফিবাদের উদ্ভব ও বিকাশ
সুফিবাদ কি ? সুফী দরবেশ কারা ?
''সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য। কি চমৎকার দেশ এই বাংলা-যেখানে অসংখ্য সুফী-দরবেশ ও তাপস বিভিন্ন দিক থেকে আগমন করেন এবং বাংলাকেই তাদের দেশ ও বসবাসের স্থান হিসাবে বেছে নেন। দৃষ্টান্তরূপ, পীরানা পীর হযরত শিহাবউদ্দীন সোহরাওয়ার্দী সত্তুর জন নেতৃস্থানীয় শিষ্য দেবগায়ে চিরশান্তির কোলে শায়িত আছেন।
সোহরাওয়ার্দী তরীকার কয়েকজন সুফী মহীসুনে এবং জালালিয়া তরীকার সুফীরা দেওতলায় সমাহিত আছেন। শেখ আহমদ দামেস্কীর কয়েকজন প্রধান শিষ্য আছেন নারকোটিতে। 'কদর খানই' দ্বাদশ সূফীদের অন্যতম হযরত শেখ শরফ-উদ্দিন তাওয়ামা সোনারগাঁয়ে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন।
তারই প্রধান শিষ্য ছিলেন হজরত শেখ শরফুউদ্দিন মানেরী। এ ছাড়া, হযরত বদি আলম ও বদর আলম জাহেদী ছিলেন শিষ্য। মোটকথা বাংলাদেশে শুধু বড় বড় শহরের কথা বলি কেন, এমন কোনো গ্রাম কিংবা শহর নেই, যেখানে পুণ্যাত্না সূফীবৃন্দ গমন করেন নাই ও বসতি স্থাপন করেন নাই।
সোহরাওয়ার্দী তরীকার ক্বামেলগনের অনেকেই আজ বিগত, কিন্তু যারা জীবিত আছেন তাদের সংখ্যাও অনেক।'' স্বনামখ্যাত বাঙালি সুফী শেখ আলাউল হকের প্রসিদ্ধ শিষ্য মীর সৈয়দ আশরাফ জাহাঙ্গীর সীমনানি (মৃত্যু ১৩৮০ খৃ:) এই পত্রটি লিখেছিলেন জৌনপুরের সুলতান ইবরাহীম শর্কীর নিকট। পুরো পত্রটির অংশমাত্র উপরে উদ্ধৃত করা হলো।
অসাধারণ উপন্যাস টি কিনতে ক্লিক করুন
সোহরাওয়ার্দীয়া তরীকার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শেখ নজিব-উদ-দীন আব্দুল কাদির। জিবালের অন্তর্গত সোহরাওয়ার্দ নগরে তার জন্ম। ১১৬৯ সালে তার ইন্তিকালের পর তার ভ্রাতুষ্পুত্র শিহাব-উদ-দীন উমর বিন আব্দুল্লাহ সোহরাওয়ার্দী এই তরীকার বিশেষ উৎকর্ষ সাধন করেন এবং তারই জন্যে অনেকেই তাকে সোহরাওয়ার্দীয়া তরীকার প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা মনে করেন।
তারই রচিত বিখ্যাত তাসাওউফ গ্রন্থের নাম আওয়ারিফ-উল-মু আরিফ। শেখজীর বহু শিষ্য এই উপমহাদেশে আগমন করেন। তাদের অন্যতম শেখ জালাল-উদ-দীন তবরেজী মুলতান ও দিল্লী হয়ে বাংলায় আসেন। বাংলায় তার শিষ্যরা জালালীয়া নামধারণ করেন। সুফী শেখ জালাল-উদ-দীন তবরেজীর সম্মানার্থে দেওতলার নাম হয় তবরীজাবাদ সুফী সৈয়দ আশরাফ সিমনানির পত্রে 'আলাই', 'খালিদীয়া', 'নূরী' তরীকার উল্লেখও রয়েছে।
পাণ্ডুয়ার খ্যাতনামা দরবেশ শেখ আলাউল হক থেকেই 'আলাই' তরীকার উদ্ভব এবং শেখ আলাউল হক বিখ্যাত কোরেশ সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদের বংশধর হওয়ায় তার শিষ্য সম্প্রদায় 'খালিদীয়া' পরিচিতিও ব্যবহার করেন। শেখ আলাউল হকের সুযোগ্য পুত্র হযরত নূর কুতুব-ই আলম তার শিষ্য সম্প্রদায় নূরী নামেও পরিচিত। এমনি আরও তরীকার উদ্ভব হয় এই বাংলায়। সুফীবাদের এইসব শাখা-প্রশাখা এবং সুফী-দরবেশেদের প্রতিষ্ঠিত অসংখ্য খানকাহ ও দরগার অস্তিত্ব বাংলায় সুফীবাদের জনপ্রিয়তারই স্মৃতিই বহন করে।
বিশ্ব সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে জানতে ঘুরে আসুন বাংলার পাঁচ মুক্ত সাহিত্যকোষ থেকে
উপরোক্ত শাখা-প্রশাখা তরীকা ছাড়াও পরবর্তীতে বাংলায় আরও প্রধান প্রধান তরীকার উদ্ভব ঘটে, যার মধ্যে রয়েছে কাদেরীয়া তরীকা, চিশতীয়া তরীকা, নক্শবন্দিয়া তরীকা এবং সততারিয়া, মাদারীয়া, কলন্দরিয়া প্রভৃতি তরিকা। কিন্তু তরীকা, ছাড়িয়েও মূল কথা হচ্ছে সুফী-দরবেশদের দ্বারা বাংলায় ইসলাম প্রচার-প্রসার ও প্রতিষ্ঠার কথা।
বাংলায় সুফী দরবেশদের আগমন
বাংলার মুসলমানদের আগমন এবং এখানে মুসলিম রাজ্যের প্রতিষ্ঠা ও বিস্তৃত প্রসঙ্গে একটা বিশেষ প্রশ্ন আজও চালু আছে, এবং তা হচ্ছে , সুফী-সাধকরা প্রথমে ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে অমুসলিমদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে মুসলিম শাসকরা তাদের সাহায্যে এগিয়ে যেতেন, অথবা মুসলিম শাসকদের সঙ্গে সীমান্তবর্তী অমুসলিম রাজাদের মধ্যে যুদ্ধ বাধলে সুফী-সাধকরাও মুসলিম সৈন্যদের সঙ্গে যোগ দিতেন ?
অন্য কথায়, প্রশ্নটা হলঃ ইসলামের প্রসারে প্রতিষ্ঠায় এবং সেই সঙ্গে মুসলিম অধিকারে বিস্তারে সুফী-সাধকদের ভূমিকা ছিল মুখ্য বা গৌণ ? উত্তরে ডক্টর আব্দুল করিমের কথায় বলা যায়, ''বাংলাদেশের ইসলাম প্রচারে সূফীদের ভূমিকা আলোচনা করিলে দেখা যায় যে, সুফীরা প্রথমে ধর্ম প্রচারে বাহির হইতেন।
দৃষ্টান্তরূপ বাংলার সুলতান শামস-উদ-দীন ফিরোজ শাহর আমলে হুগলি জেলার সাতগাঁও এলাকা ও সিলেট বিজয় এবং সুলতান ফখর-উদ-দীন মুবারক শাহর সময়ে চট্রগ্রাম এলাকা বিজয়ের কথা স্মরণ করা যায়। সাতগাঁও এলাকা জয়ের পেছনে ছিল শাহ সফি-উদ-দীনের ঐ অঞ্চলে ইসলাম প্রচার কালে স্থানীয় হিন্দু প্রধানের সঙ্গে সংঘর্ষে অবতারণা এবং এ সংঘর্ষে শাহ সফি-উদ-দীনকে সাহায্য করা জন্য সুলতান ফিরোজ শাহর পক্ষ থেকে সৈনবাহিনীসহ জাফর খানকে প্রেরণ।
সিলেট বিজয়ের ব্যাপারেও রাজা গৌর গৌবিন্দের বাহিনীর হাতে পরপর পরাজিত হন সুলতানের সেনাপতি সিকান্দার খান গাজী। তারপর আসেন সুহেল-ই-ইয়েমন হজরত শাহ-ই-জালাল। সৈয়দ নাসির-উদ-দীনকে নিযুক্ত করা হয় শাহ-ই-জালালের সঙ্গে আগত শিষ্যবৃন্দের সেনাপতি। বিজিত হয় সিলেট অঞ্চল।
চট্রগ্রাম এলাকা বিজয়েও প্রথমে আসে কদল খান গাজীর নাম। সুফী কদল গাজী ও তার শিষ্য-সঙ্গীরা চট্রগ্রাম এলাকায় এসে স্থানীয় প্রধানদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হন। সুলতান ফখর-উদ-দীন মুবারক শাহ তাদেরকে সৈন্য দিয়ে সাহায্য করেন এবং চট্রগ্রাম এলাকা মুসলমানদের অধিকারে আসে।
আরো পড়ুন :
Post a Comment