মুতার যুদ্ধ : মুহাম্মাদ (সাঃ) জীবদ্দশায় সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ
সেনা নায়কদের শাহাদাত
মুতা নামক জায়গায় উভয় দলের মধ্যে সংঘর্ষ বেধে অত্যন্ত তিক্ত লড়াই হয়। মাত্র তিন হাজার মুসলিম সৈন্য দুই লাখ অমুসলিম সৈন্যের সাথে এক অসম যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন। বিসম্ময়কর ছিলো এ যুদ্ধ। দুনিয়ার মানুষ অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো। ঈমানের বাহাদুরি চলতে থাকলে এ ধরনের বিস্ময়কর ঘটনাও ঘটে।
সর্বপ্রথম রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রিয় পাত্র হযরত যায়েদ ইবনে হারেছ (রাঃ) পতাকা গ্রহণ করেন। অসাধারণ বীরত্বের পরিচয় দিয়ে তিনি শাহাদত বরণ করেন। এ ধরণের বীরত্বের পরিচয় মুসলমান ব্যতীত অন্য কারো ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায়নি।
হযরত যায়েদ-এর শাহাদাতের পর পতাকা তুলে নেন হযরত জাফর ইবনে আবু তালেব। তিনিও তুলনাহীন বীরত্বের পরিচয় দিয়ে লড়াই করতে থাকেন। তীব্র লড়াইয়ের এক পর্যায়ে তিনি নিজের সাদাকালো ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফিয়ে পড়ে শত্রুদের ওপর আঘাত করতে থাকেন। শত্রুদের আঘাতে তার ডানহাত কেটে গেলে তিনি বাঁ হাতে যুদ্ধ শুরু করেন। শাহাদাত বরণ করা পর্যন্ত এভাবে পতাকা ধরে রাখেন।
ইমাম বোখারী(রা) নাফে-এর মাধ্যমে আবদুল্লাহ ইবনে ওমর(রা) (রা.)একটি বর্ণনা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, মুতার যুদ্ধের দিনে হযরত জাফর শহীদ হওয়ার পর আমি তার দেহে আঘাতের চিহ্নগুলো গুণে দেখেছি।
তার দেহে তীর ও তলোয়ারের পঞ্চাশটি আঘাত ছিলো। এ সব আঘাতের একটিরও পেছনের দিকে ছিলো না উভয় বর্ণনায় সংখ্যার পার্থক্য রয়েছে। পার্থক্য নিরসন এভাবে করা হয় যে, তীরের আঘাতের সংখ্যাসহ ৯০টি।
অপর এক বর্ণনায় রয়েছে যে, আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) বলেন, আমি মুতার যুদ্ধে মুসলমানদের সঙ্গে ছিলাম। জাফর ইবনে আবু তালেবকে সন্ধান করে নিহতদের মধ্যে তাদেরকে পেয়ে যাই। তার দেহে বর্শা ও তীরের ৯০টির বেশি আঘাত দেখেছি।
নাফে থেকে বর্ণিত রয়েছে , ইবনে ওমরের বর্ণনায় এও আছে যে, আমি এসকল জখম লক্ষ্যে করেছি তার দেহের সম্মুখভাগে। উভয় বর্ণনায় সংখ্যার পার্থক্য রয়েছে। পার্থক্য নিরসন এভাবে করা হয় যে, তীরের আঘাতের সংখ্যাসহ ৯০টি। বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের মাধ্যমে হযরত জাফর (রা.)-এর শাহাদাত বরণের পর হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে রওয়াহা (রা.) পতাকে গ্রহণ করে ঘোড়ার পিঠে আরোহণ করে সামনে অগ্রসর হন। কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্বের পর তিনি এ কবিতা আবৃতি করেন,
'ওরে মন খুশি বেজার যেভাবে হোকমোকাবেলা কর। যুদ্ধের আগুন জ্বেলেছে ওরাবর্শা রেখেছে খাড়া। জান্নাত থেকেকেনরে তুই থাকতে চাস দূরে?'
এরপর হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (রাঃ) বীর বিক্রমে যুদ্ধ করতে থাকেন। তার চাচাতো ভাই গোশত লেগে থাকা একটা হাড় তার হাতে দেন। তিনি এক কামড় খেয়ে ছুড়ে ফেলেন। এরপর লড়াই করতে তিনি শাহাদত বরণ করেন।
আল্লাহর তলোয়ার
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা শাহাদাতের পর বনু আযলান গোত্রের ছাবেত ইবনে আরকাম একজন সাহাবী গ্রহণ করেন। তিনি বলেন, হে মুসলমানরা, তোমারা উপযুক্ত একজনকে সেনাপতির দায়িত্ব দাও। সাহাবারা ছাবেতকেই সেনাপতির দায়িত্ব নিতে বললে তিনি বলেন, আমি একাজের উপযুক্ত নই।
এরপর সাহাবারা হযরত খালেদ ইবনে ওলীদ (রা.) কে সেনাপতি নিযুক্ত করেন। তিনি পতাকা গ্রহণের পর তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। সহীহ বোখারীতে স্বয়ং খালেদ ইবনে ওলীদ (রা.) থেকে বর্ণিত রয়েছে যে, মুতার যুদ্ধের দিনে আমার হাতে ৯টি তলোয়ার ভেঙ্গেছে। এরপর আমার হাতে একটি ইয়েমেনী ছোট তলোয়ার অবশিষ্ট ছিলো।
অপর এক বর্ণনায় তার যবানীতে এভাবে উল্লেখ রয়েছে যে, মুতার যুদ্ধের দিনে আমার হাতে ৯টি তলোয়ার ভেঙ্গেছে। এরপর আমার হাতে একটি ইয়েমেনী ছোট তলোয়ার অবশিষ্ট ছিলো।
এদিকে রসূলুল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম রণক্ষেত্রের খবর লোক মারফত পৌঁছার আগেই ওহীর মাধ্যমে পান। তিনি বলেন, যায়েদ পতাকা গ্রহণ করেছিলেন, তিনি শহীদ হন। এরপর জাফর পতাকা গ্রহণ করেছিলেন তিনি শহীন হন।
এরপর আব্দুল্লাহ ইবনে রওয়াহা পতাকা গ্রহণ করেছিলেন, তিনিও শহীন হন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া সাল্লামের চোখ এ সময় অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। তিনি বলেন, এরপর পতাকা গ্রহণ করেন আল্লাহর তলোয়ার সমূহের মধ্যে একটি তলোয়ার।
যুদ্ধের সমাপ্তি
বীরত্ব বাহাদুরি ও নিবেদিত চিত্ততা সত্ত্বেও মুসলমানদের মাত্র তিন হাজার সৈন্য দুই লাখ অমুসলিম সৈন্যের সামনে টিকে থাকা এক বিস্ময়কর ঘটনা। হযরত খালেদ ইবনে ওলীদ (রাঃ) এ সময় যে বীরত্বের পরিচয় দেন ইতিহাসে তার তুলনা খুঁজে পাওয়া যায় না।
এ যুদ্ধের পরিণতি সম্পর্কিত বর্ণনাসমূহে যথেষ্ট মতভেত রয়েছে। সকল বর্ণনা পাঠ করার পর জানা যায় যে, যুদ্ধের প্রথম দিন শেষ পর্যায়ে হযরত খালেদ (রা.)রোমক সৈন্যদের মোকাবেলায় অবিচল ছিলেন। তিনি সেই সময় এক নতুন যুদ্ধকৌশলের কথা ভাবছিলেন, যাতে রোমকদের প্রভাবিত করা যায়।
সেই কৌশলের মাধ্যমে ধীরে ধীরে মুসলমানদের পিছিয়ে নেয়ায় ছিলো উদ্দেশ্য। তবে, কোন অবস্থায়ই রোমকরা যেন ধাওয়া করতে না পারে, সেটা লক্ষ্য রাখতে হবে। কেননা রোমকরা ধাওয়া করলে তাদের কবল থেকে রক্ষা পাওয়া হবে খুবই কঠিন।
পরদিন সকালে হযরত খালেদ (রা.)সেনাদল রদবদল করে বিন্যাস্ত করলেন। ডানদিকের সৈন্যদেরকে বাঁদিকে এবং বাঁদিকের সৈন্যদের পেছনে নিয়ে গেলেন। এরূপ আদল বদলে দৃশ্য থেকে শত্রুরা বলাবলি করতে লাগলো যে, মুসলমানর সহায়ক সৈন্য পেয়েছে, তাদরে শক্তি পূর্বাপেক্ষা বৃদ্ধি পেয়েছে।
সেনা বিন্যাস অদল বদল করে হযরত খালেদ (রাঃ) মুসলমানদের ধীরে ধীরে পিছিয়ে নিলেন। রোমক সৈন্যরা মুসলমানদের আক্রমণ করতে এগিয়ে গেলো না কারণ তারা তখন ভাবছিলো যে মুসলমানরা ধোকা দিচ্ছে। তার মরুপ্রান্তেরে নিয়ে পাল্টা হামলা করে পর্যদুস্ত করবে। এরূপ চিন্তা করে রোমক সৈন্যরা মুসলমানদের ধাওয়া না করে নিজেদের এলাকায় ফিরে গেলো। এদিকে মুসলমানরা পিছাতে পিছাতে মদীনায় গিয়ে পৌছালেন।
হতাহতের সংখ্যা
মুতার যুদ্ধে ১২ জন মুসলমান শাহাদত বরণ করেন। রোমকদের মধ্যে কতসংখ্যক হতাহত হয়েছে তার বিবরণ জানা যায়নি। তবে যুদ্ধের বিবরণ পাঠে বোঝা যায় যে তাদের বহু হতাহত রয়েছে। কেননা একমাত্র হযরত খালেদের হাতেই ৯টি তলোয়ার ভেঙ্গেছিলো। এতেই শত্রু সৈন্যদের হতাহতের সংখ্যা সহজেই আন্দাজ করা যায়।
মুতার যুদ্ধের প্রভাব
যে প্রতিশোধ গ্রহণের উদ্দেশ্যে মুতা অভিযান পরিচালিত হয়েছিলো, সেটা সম্ভব না হলেও এ যুদ্ধের ফলে মুসলমানদের সুনাম সুখ্যাতি বহু দূর বিস্তার লাভ করে। সমগ্র আবর জগত বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। কেননা, রোমকরা ছিলো সে সময়ের শ্রেষ্ঠ শক্তি। আবরব মনে করতো যে, রোমকদের সাথে সংঘাতে লিপ্ত হওয়া মানে আত্মহত্যার শামিল।
কাজেই, উল্লোখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতি ছাড়া তিনহাজার সৈন্য দুই লাখ সৈন্যের মোকাবেলায় আরবের জনগণ বুঝতে সক্ষম হয়েছিলো যে, ইতিপূর্বে পরিচিতি সকল শক্তির চেয়ে মুসলমানরা সম্পূর্ণ আলাদা। তাদের নেতা মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিঃসন্দহে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।
এ কারণেই দেখা যায় যে, মুসলমানদের চিরশত্রু জেদী ও অহংকারী হিসেবে পরিচিত বেশ কিছু সংখ্যক গোত্র মুতার যুদ্ধের পর ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে। এসব গোত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গোত্র হচ্ছে, বনু ছালিম, আশজা, গাতফান, জিবান ও ফাজারাহ।
মুতার যুদ্ধের প্রাক্কালে রোমকদের সাথে যে রক্তক্ষয়ী সংঘাত শুরু হয়েছিল এর ফলেই পরবর্তীকালে মুসলমানদের বিজয় গৌরব দূরদূরান্তে বিস্তার লাভ করে।
আরো পড়ুন :
Post a Comment