শিবলী নোমান : উর্দু ভাষায় আধুনিক ইতিহাস লিখনধারার জনক    

শিবলী নোমান : উর্দু ভাষায় আধুনিক ইতিহাস লিখনধারার জনক




শিবলী নোমানী ছিলেন বিভাগপূর্ব ভারতের একজন কবি, দার্শনিক, ইতিহাসবেত্তা, প্রাবন্ধিক, জীবনীকার, সাহিত্য সমালোচক, বাগ্মী এবং ইসলামি পণ্ডিত। তিনি উর্দু ভাষায় আধুনিক ইতিহাস লিখনধারা'র জনক হিসেবে বিবেচিত। 

তাকে উর্দু সাহিত্যের পঞ্চভিত্তির একজন ধরা হয় এবং উর্দু সাহিত্যে তিনিই প্রথম ঐতিহাসিক সমালোচক। সাহিত্যের সকল শাখায় তার পদচারণা রয়েছে। আলিগড় কলেজে অধ্যাপনা জীবনের শুরুতে সৈয়দ আহমদ খানের চিন্তাধারায় প্রভাবিত হয়ে তিনি আলিগড় আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করেন। পরবর্তীতে তিনি এই আন্দোলন থেকে সরে গিয়ে নদওয়াতুল উলামার সাথে যুক্ত হন। 

তিনি দেওবন্দি মতাদর্শের সমর্থক ছিলেন। তিনি ইসলামের অতীত ঐতিহ্যকে ঠিক রেখে আধুনিক চিন্তাধারার সাথে সমন্বয়ের প্রয়াস পেয়েছিলেন। ১৯১০ থেকে ১৯৩৫ পর্যন্ত উর্দুতে যে ইসলামি সাহিত্য সৃষ্টি হয় অনেকাংশেই তা শিবলীর প্রাচীন ও আধুনিকের সমন্বয় সাধনের ফল। শেষজীবনে রচিত সীরাতুন নবী তার সর্বশ্রেষ্ঠ রচনা। বিদ্যাবত্তার স্বীকৃতি স্বরুপ উসমানি খেলাফত তাকে ‘তমঘায়ে মজিদি’ এবং ব্রিটিশ সরকার ‘শামসুল উলামা’ উপাধি প্রদান করে।


তিনি ১৮৫৭ সালে আজমগড়ে জন্মগ্রহণ করেন।  শিক্ষাজীবনে কয়েকটি মাদ্রাসায় পড়ার পাশাপাশি তিনি আহমদ আলী সাহারানপুরির নিকট হাদিস অধ্যয়ন করেছেন। ১৮৮২ সালে আলিগড় কলেজে তার অধ্যাপনা জীবনের শুরু। অধ্যাপনা জীবনে সৈয়দ আহমদ খান ও টমাস ওয়াকার আর্নল্ডের সাথে সুসম্পর্কের কারণে তিনি উপকৃত হয়েছিলেন।

Bohubrihi online courses


 ১৮৮৩ সালে তিনি একটি জাতীয় স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন যা পরবর্তীতে শিবলী জাতীয় কলেজে রূপান্তরিত হয়। ১৮৮৮ সাল থেকে প্রবন্ধ ও কবিতা রচনার মাধ্যমে তার সাহিত্য সাধনা শুরু হয়। ১৮৯২ সালে তিনি তুরস্ক সহ কয়েকটি মুসলিম দেশ ভ্রমণ করেন। ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত তিনি আলিগড়ে অধ্যাপনা করেছেন। এসময়ে তিনি আল মামুন, সীরাতুন নোমান, আল ফারুকের মত জীবনী সাহিত্য সৃষ্টি করেন।

 সৈয়দ আহমদ খানের মৃত্যুর পর তিনি আলিগড়ের অধ্যাপনা ছেড়ে দেন। ১৯০১ সালে তিনি দাইরাতুল মাআরিফ নামক গবেষণা কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত হন। একইসাথে তিনি আঞ্জুমানে তারাক্কিয়ে উর্দুর মহাসচিব ছিলেন। আল গাজ্জালী, ইলমুল কালাম সহ পাঁচটি গ্রন্থ রচনা করেন এখানে। সেখানে তিনি একটি প্রাচ্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনাও সম্পন্ন করেছিলেন। 

হায়দ্রাবাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণে ১৯০৫ সালে তিনি দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামায় চলে এসে শিক্ষা সচিব হিসেবে যোগদান করেন। তার আমলে নদওয়ার শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যাপক সংস্কার আনয়ন করেন। ১৯০৬ সালে তিনি তার বিখ্যাত ফার্সি কাব্যগ্রন্থ শেরুল আজম রচনা করেন। এসময়ে তিনি আন নদওয়া নামক একটি উচ্চমানের সাহিত্য পত্রিকাও প্রতিষ্ঠা করেন। 

১৯১৩ সালে নদওয়া থেকে পদত্যাগ করে তিনি মাদরাসাতুল ইসলাহ ও দারুল মুসান্নিফীন প্রতিষ্ঠা করেন। এসময়ে তিনি সীরাতুন নবী রচনার কাজ শুরু করেন। ২ খণ্ড রচনার পর ১৯১৪ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার অন্তিম ইচ্ছানুসারে তারই ছাত্র সুলাইমান নদভী ৭ খণ্ডে এটি সমাপ্ত করেন। সর্ব ইসলামবাদের সমর্থক হিসেবে তিনি উসমানি খেলাফতের সমর্থন করতেন। 

ভারতীয় রাজনীতিতে হিন্দু-মুসলিমের ঐক্য প্রত্যাশী হিসেবে তিনি কংগ্রেসের সমর্থক এবং মুসলিম লীগের সমালোচক ছিলেন। ১৯৯২ সালে তার সম্মানে পাকিস্তান সরকার একটি স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করেছে।  তার জীবনকর্মের উপর সুলাইমান নদভী রচিত হায়াতে শিবলী অন্যতম। 



amazon



জন্ম ও বংশ 


শিবলী নোমানীর জন্ম ১৮৫৭ সালের ১ জুন। তিনি ব্রিটিশ ভারতের উত্তরপ্রদেশের আজমগড় জেলার বিন্দুল নামক গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। তিনি শিওরাজ সিং-এর বংশধর ছিলেন যিনি পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করে সিরাজ উদ্দিন নাম ধারণ করেন।তার বংশধররা রোতারাহ নামে পরিচিতি লাভ করে। তার পিতা হাবিবুল্লাহ একজন জমিদার ও উকিল ছিলেন।


শিক্ষাজীবন 


ছয় বছর বয়সে গ্রামের পাঠশালায় তার শিক্ষার হাতেখড়ি হয়। কুরআন ও ফার্সি কিতাব পড়ার পর তিনি জৌনপুরের মাদ্রাসায়ে হানাফিয়ায় কিছুদিন পড়াশোনা করেছেন। এরপর তিনি ভর্তি হন আজমগর শহরের পূর্ব দিকে ঘুসি নামক গ্রামে অবস্থিত মাদ্রাসা নাসেরুল উলুমে। এখানে পড়াশোনার সমাপ্তির পর তার পিতা তাকে মাদ্রাসা চশমায়ে রহমত, গাজীপুরে পাঠিয়ে দেন। 

পরবর্তীতে তার পিতা ও অন্যন্য প্রভাবশালী ব্যাক্তির সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত হয় মাদ্রাসায়ে আরাবিয়া আজমগড়। তিনি এই মাদ্রাসায় চলে আসেন। এই মাদ্রাসায় শিক্ষাকালীন সময়ে তিনি গবেষণায় মনোযোগ দেন এবং ফার্সি ভাষা ও সাহিত্য ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। এরপর তিনি রামপুর সফর করেন এবং এরশাদ হোসেন মুজাদ্দেদির কাছে ফিকহ ও উসূলে ফিকহের শিক্ষা অর্জন করেন। 

এরপর তিনি লাহোর গমন করে ওরিয়েন্টাল কলেজের অধ্যাপক ফয়জুল হাসান সাহারানপুরির কাছে আরবি সাহিত্য ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন।  সর্বশেষে তিনি আহমদ আলী সাহারানপুরির নিকট হাদিস অধ্যয়ন করেছেন। 

Buy on Aliexpress



মধ্যজীবন 


১৮৭৬ সালে ১৯ বছর বয়সে তিনি পিতার সাথে হজ্জে চলে যান। হজ্জ থেকে ফেরার পর ১৮৭৯ সালে তিনি উকালতি পরীক্ষা দেন। কিন্তু আইন বিষয়ে আগ্রহ না থাকায় অকৃতকার্য হন। ১৮৮০ সালে দ্বিতীয়বারের পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ হন। ১৮৮১ সালে তিনি আজমগড়ে ওকালতি শুরু করেন। এই পেশা বাদ দিয়ে ১৮৮২ সালে তিনি প্রথম আদালতে কালেক্টরির দলিল নকল লেখক হিসেবে কাজ করেন।

 এরপর তার পিতার নীল কারখানার দায়িত্ব দেওয়া হয়। এটাও ছেড়ে দিয়ে তিনি জৈনক মাওলানার সাথে গ্রামে চলে যান। ১৮৮৩ সালের ১ জানুয়ারি তিনি মোহামেডান এংলো ওরিয়েন্টাল কলেজের প্রাচ্য ভাষা বিভাগের অধ্যাপনা শুরু করেন। কাব্য রচনার মধ্যে দিয়ে তিনি শিক্ষকদের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। ওই সময়ে তার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কাব্য হল :



  • মুর্শিয়া সর সালার জংগ (১৮৮৩)
  • কাসীদায়ে ইদিয়া (১৮৮৩)
  • মুসনবি সুবহে উমিদ (১৮৮৫)
  • মুর্শিয়া মাওলানা ফয়জুল হাসান (১৮৮৭)



কাব্য রচনার পাশাপাশি তিনি সৈয়দ আহমদ খানের কাছে আরবের ইতিহাস ও ভূগোলের উপর রচিত বই সমূহ অধ্যায়ন করেন। ফলে ইতিহাসের প্রতি তার নতুন আগ্রহ সৃষ্টি হয়। এছাড়া টমাস ওয়াকার আর্নডরের সাথে ও তার সুসম্পর্ক ছিল। সৈয়দ আহমদের সাহচার্য ও আলীগড়ে থাকাকালীন তিনি কিছু প্রবন্ধ রচনা করেন। তার প্রথম প্রবন্ধ " মুসলমানদের উচিত শিক্ষা " যা ১৮৮৭ সালে মোহামেডান এডুকেশনাল কনফারেন্স লখনৌতে পঠিত হয়। 



এসময়ে তিনি কিছু ঐতিহাসিক জীবনীগ্রন্থ রচনা করেন। "আল মামুন " ১৮৮৯ সালে রচিত প্রথম জীবনীগ্রন্থ। এরপর ১৮৯০ সালে প্রকাশ করেন "সীরাতুন নোমান " " আল ফারুক " ও এই সময়ে রচনা করেন যা ১৮৯৯ সালে প্রকাশিত "সফরনামায় রোম মিশর ও শাম গ্রন্থে এই ভ্রমণকাহিনী লিপিবদ্ধ করেন। 





শেষ জীবন 

১৮৯৮ থেকে ১৯০১ পর্যন্ত তার জীবন ছিল বিপর্যস্ত। এ সময় তিনি সার্বক্ষণিক অসুস্থতা ও নিঃসঙ্গতায় ভুগছিলেন। আল ফারুকের শেষ পৃষ্ঠা তিনি এই সময়ে রচনা করেন। ১৯০১ সালে তিনি হায়দ্রাবাদে চলে যান। এপ্রিলে থাকে " মগ্দদগার মুতামদ উমুরে মাজহাবী " এর দায়িত্ব অর্পণ করা হলেও তিনি এটি গ্রহনে অস্বীকৃতি জানায়। মে মাসে তিনি " সরিরেশতাই তালিম ওয়া ফুনুন " এর ব্যাবস্থাপক পদে নিয়োগ লাভ করেন , ১৯০৫ সাল পর্যন্ত তিনি হায়দ্রাবাদে অবস্থান করেন। এ সময়ে তিনি পাঁচটি গ্রন্থ রচনা করেন :

amazon



ইলমুল কালাম (১৯০২)

আল -কালাম (১৯০৩)

সওয়ানেহে মওলানা রুমি (১৯০৪)

মোয়াজেনা আনিস ও দাবির (১৯০৩-০৪)

আল গাজ্জালী (১৯০৬)

শেষের দিকে নদওয়ার অন্য সদেস্যদের সাথে মত পার্থক্যে দেখা দিলে জুলাই ১৯১৩ সালে তিনি পদত্যাগ করেন। ১৯১৪ সালের আগস্ট মাসে তার বড় ভাইয়ের অসুস্থার খবরে তিনি এলাহাবাদ চলে যান। সেখানে তিনি "দারুল মুসান্নিফীনের " প্রাথমিক ধারণা উদ্ভবন করেন। ১৯১৪ সালে ১৮ নভেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। 


আরো পড়ুন :













Post a Comment