আবু হামিদ মুহাম্মাদ ইবনে মুহাম্মাদ আল গাজ্জালী বাংলাদেশ সহ অনেক অঞ্চলে ইমাম গাজ্জালী নাম অধিক পরিচিত। মুসলিম বিশ্বের অন্যতম শিক্ষাবিদ ইমাম গাজ্জালী ১০৫৮ সালে ইরানের খোরাসানের তুশ নগরীতে জন্মগ্রহণ এবং মৃত্যুবরণ করেন। তার নাম তার পিতার নামের অনুরূপ মুহাম্মদ এবং তার দাদার নাম ছিল আহমদ। তার পিত তখনকার সময়ে একজন সনামধন্য সুতা ব্যাবসায়ী ছিলেন।
গাজল অর্থ সুতা , নামকরণের এই সামাঞ্জস্যতা তাই তার বংশকে গাজ্জালী নামে ডাকা হতো। আবার কারো মতে তিনি হরিনের চক্ষু বিশিষ্ট অপূরূপ সুদর্শন ছিলেন আর গাজাল অর্থ হরিণ , তাই পিত মাতা তাকে শৈশবে আদর করে গাজ্জালী নামে ডাকতো। উভয় বর্ণনা অনুসারে তাকে গাজ্জালী বলা হয়। সে সময় তিনি ইরানের শিক্ষা নিয়ে বেশ কিছু কাজ করেন। জ্ঞান অন্নেষণের জন্য তিনি দেশ ভ্রমণে ও বেরিয়েছিলেন।
শৈশব ও শিক্ষাদীক্ষা
ছোট বেলায় তিনি তার বাবাকে হারান। তার শিক্ষা জীবন ও বাল্যকাল কাটে তুশ নগরীতে। ইমাম গাজ্জালী (রহঃ) তৎকালীন যুগের শ্রেষ্ঠতম ধর্মতত্ববিদ আলেম ইমামুল হারামাইন আল জুয়াইনির কাছে কয়েক বছর অতিবাহিত করেন। পঞ্চম শতকের মধ্যভাগে এমন এক পরিস্থিতিতে ইমাম গাজ্জালী জন্মগ্রহণ করেন যখন পাশ্চাত্য ও গ্রিক দর্শনের বিস্তার লাভ করেছিল।
সেসময় যে শিক্ষা পার্থিব উন্নতির বাহন হতে পারতো , প্রথমতসেই ধরণের শিক্ষা তিনি লাভ করেন। তারপর সে যুগে যে শিক্ষার চাহিদা ছিল তাতেও তিনি পারদর্শিতা অর্জন করেন এবং তৎকালীন একজন আলেম যতদূর উন্নতির কল্পনা করতে পারতেন , ততদূর তিনি পৌঁছে যান।
কর্মজীবন
ইমাম গাজ্জালী (রহঃ) পরিনিত বয়সে ৪৮৪ হিজরীতে বাগদাদ গমন করেন। বাগদাদে তৎকালীন সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ নিজামিয়া মাদ্রাসায় তিনি অধ্যাপনায় যোগ দেন। মুসলিম দর্শন , ফিকাহ , ইলমুল কালাম (ধর্মতত্ব ) বিষয়ে তিনি সর্বকালের প্রাতস্বরণীয় মনীষীদের একজন। ইমাম গাজ্জালীর আধ্যাতিক জ্ঞানের প্রতি ছিল অগাধ তৃস্না। নিজামিয়া মাদ্রাসায় এই জ্ঞান পিপাসা নিবারণ করতে পারেনি। তাই অল্প সময়ের মধ্যে নিজামিয়া মাদ্রাসার অধ্যাপনা ছেরে সৃষ্টি রহস্যের সন্ধানে তিনি পথে বেরিয়ে পরে।
প্রায় দশ বছর পর তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল সফর করে অবশেষে তিনি বাগদাদে তৎকালীন পৃথিবীর বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয় বাগদাদের নেজামিয়া বিশ্ববিদ্যালয় বাগদাদের নিজামিয়া বিশ্ববিদ্যালয় যোগদান করেন। সেলজুক সম্রাজ্যের নিজাম - উল - মূলক তুসী ও মেলিক শাহ সেলজুকী ও বাগদাদের খলিফার দরবারে যোগ্য আসন লাভ করে।
সমকালীন রাজনীতিতে এত বেশি প্রভাব বিস্তার করেন যে , সেলজুকী শাসক মেলিক শাহ ও আব্বাসীয় খলিফার মধ্যে সৃষ্ট মতবিরোধ দূর করার জন্য তার খেদমত হাসিল করা হতো। পার্থিব উন্নতির এই পর্যায়ে উপনীত হবার পর অকস্মাৎতার জীবনে বিপ্লব আসে। নিজের যুগের তত্ত্বগত নৈতিক ধর্মীয় , রাজনৈতিক ও তমুদ্দনিক জীবনধারাকে যত গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন , ততই তার মধ্যে বিদ্রোহের আগুন জ্বলতে থাকে এবং ততই বিবেক তার স্বরে শুরু করে যে , এই পুঁতিগন্ধময় সমুদ্রে সন্তরণ করা তোমার কাজ নয় , তোমার কাজ অন্য কিছু।
অবশেষে সমস্ত রাজকীয় মর্যাদা , লাভ , মুনাফা ও মর্যাদাপূর্ণ কার্যসমূহকে ঘৃণাভাবে দূরে নিক্ষেপ করে। কেননা এগুলোই তার পায়ে শিকল পরিয়ে দিয়েছিলো। অতঃপর ফকিরবেশে দেশে দেশে পর্যটনে বেরিয়ে পরে। বনে জঙ্গলে ও নির্জন স্থানে বসে নিলিবিলিতে চিন্তায় মগ্ন হন। বিভিন্ন এলাকায় সাধারণ মুসলমানদের সঙ্গে মেলামেশা করে তাদের জীবনধারা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন।
দীর্ঘকাল মোজাহাদা ও সাধনায়র মাধ্যমে নিজের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করতে থাকেন। ৩৮ বছর বয়েসে বের হয়ে পূর্ণ দশ বছর পর ৪৮ বছর বয়সে নিজ দেশে ফিরে আসেন। ওই দীর্ঘকালীন চিন্তা ও পর্যবেক্ষণের পর তিনি যে কার্য সম্পাদন করেন তা হলো এই যে বাদশাদের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করেন। সরকারি প্রভাবাধীনে পরিচালিত শিক্ষায়তনসমূহে কাজ করতে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন এবং তুশে নিজের একটি স্বাধীন প্রতিষ্টান কায়েম করেন।
ইমাম গাজালি ছিলেন মুসলিম জাতির শ্রেষ্ঠ দার্শনিক। তার চিন্তাধারাকে ধর্মীয় ধর্মতত্ত্বের বিবর্তন বলে। ফালাসিফা বা দার্শনিকদের বিরুদ্ধে তিনি বলেন- দার্শনিক মতবাদ কখনো ধর্ম চিন্তার কারণ হতে পারে না। কেবলমাত্র ওহির জ্ঞান পাওয়া সম্ভব। তিনি সমকালীন দার্শনিক দর্শন-চিন্তার অপূর্ণতা দেখতে পান এবং তাদের সংশোধন করেন। ফালাফাতুল উউলুল ফালাফা গ্রন্থে তিনি দার্শনিক চিন্তার শূন্যতা প্রদর্শন করেন।
Post a Comment