মুর্শিদাবাদ নিযামত আমল : নবাব সুবাদার মুর্শিদ কুলী খান (১৭১৭-১৭২৭ সাল) 




মুর্শিদাবাদ নিযামত আমল : নবাব সুবাদার মুর্শিদ কুলী খান






১৭১৭ সালের নভেম্বর মাসে মুর্শিদ কুলি খান বাংলার নিয়মিত সুবাদার নিযুক্ত হন। মুর্শিদাবাদের পূর্ব নাম ছিল মখসুদাবাদ; মুর্শিদ কুলি জাফর খান মুর্শিদাবাদে বাংলার রাজধানী স্থানান্তরিত করার পর তার নামানুসারে মুখসুবাদের নাম হয় মুর্শিদাবাদ।

 মুগল প্রশাসনে সম্রাট আকবরের সময় থেকেই সুবার রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব ছিল দেওয়ানের হাতে এবং এ ব্যাপারে দেওয়ান ছিলেন স্বাধীন, এতে সুবাদারের হস্তক্ষেপ করার অধিকার ছিল না। শাহযাদা আজিম-উশ-শানের সুবাদারি কালে মুকাররমত খান ছিলেন বাংলা সুবার দেওয়ান। আওরঙ্গজেব তখন মুগল সম্রাট। এই দেওয়ান তার অন্যান্য কর্মচারীর যোগসাজশে সুবার আদায়কৃত রাজস্ব আত্মসাৎ করেন বলে জানা যায়। 





বিশ্ব সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে জানতে ঘুরে আসুন বাংলার পাঁচ মুক্ত সাহিত্যকোষ থেকে  





বাংলার দায়িত্বভার গ্রহণ করে তিনি রাজস্ব প্রশাসনের পুনর্বিন্যাস করেন এবং রাজস্ব আদায়ে শৃঙ্খলা স্থাপন করে তার পরিণামও বাড়তে সক্ষম হন। তাতে করে সম্রাটের কাছে তার কর্মক্ষমতার সুখ্যাতি বৃদ্ধি পেলেও বাংলার সুবাদার শাহযাদার পক্ষ থেকে শত্রুতা ছাড়া আর কিছুই পাই নি।

 এই শত্রুতার সূত্র ধরেই সম্রাট আওরঙ্গজেব সুবাদার-শাহযাদাকে ভবিষ্যতের জন্য সাবধান করে দেন। কিন্তু শত্রুতা থেকেই যায়। তারই পরিণামে মুর্শিদ কুলী খান দেওয়ানী প্রশাসনের কেন্দ্র ঢাকা থেকে মুখসুদাবাদে স্থানান্তরিত করেন ১৭০২ সালে। ঢাকায় থেকে যায় সুবাদারের প্রশাসন কেন্দ্র। অল্পকাল পরে, এই শত্রুতারই পরিণামে করতলব খানকে বিহারের নায়েব সুবাদারের বাড়তি দায়িত্ব দেওয়া হয়। 








এই ঘটনার আগে বা পরে ১৭০৩ সালে তিনি দাক্ষিণাত্যে সম্রাটের কাছে উপস্থিত হন। সেখানেই করতলব খানকে সম্রাট 'মুর্শিদ কুলী খান' উপাধিতে ভূষিত করেন এবং মুখসুদাবাদের নাম পরিবর্তন করে মুর্শিদাবাদ রাখার প্রস্তাব অনুমোদন করেন। 



কিন্তু এই মৃত্যু দুইটির আগে ১৭১০ সাল অর্থাৎ সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর বছর তিনেক মুর্শিদ কুলী খানের কর্মজীবনে স্বাভাবিকভাবেই বিপর্যয় নেমে এসেছিল। তিনি হারিয়েছিলেন বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার পদগুলো; দেওয়ানরূপে আবার বদলি হয়েছিলেন দাক্ষিণাত্যে। কিন্তু তার অনুপস্থিতিতে এসব সুবায় নেমে এসেছিল বিশৃঙ্খলা। 



এর কয়েক বছর দিল্লীর মসনদ নিয়ে চলে মৃত্যুর লীলা-খেলা; এবং এসব ঘটনার পর ১৭১৭ সালে মুর্শিদ কুলী লাভ করেন বাংলার সুবাদারির দায়িত্ব। সুবাদার হিসেবে তিনি ছিলেন ন্যায়পরায়ণ, বিচক্ষণ, প্রজাবৎসল অথচ প্রশাসনে কঠোর। 


অসাধারণ প্রতিভাসম্পন্ন এই সুবাদারের সুদীর্ঘ বিচক্ষণ শাসনামলে বাংলার রাজস্ব বিভাগের বিপুল উন্নতি যেমন সাধিত হয়, তেমনি সারা বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হয় শান্তি-শৃঙ্খলা। ব্যাক্তিগত জীবনে মুর্শিদ কুলী  খান ছিলেন পরম ধর্মনিষ্ঠ। কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে, শায়েস্তা খানের পর ভারতের কথাও মুর্শিদ কুলীর মত উপযুক্ত কোন সুবাদার দেখা যায়নি। 



তার সুবাদারির সময়টাই ছিল এমন যে তারই বাস্তবতায় সুবা বাংলা লাভ করে, বলতে গেলে, এক স্বাধীন সত্তা। ঐ সময়টায় যে মুগল শক্তিতে ধস নামতে আরম্ভ করেছে, তা আগেই বলা হয়েছে। দিল্লীর মসনদ নিয়ে তখন দ্বিতীয় হার ও তৃতীয় হার দেড় মধ্যে আরম্ভ হয়েছিল হানাহানি। 


এমনি একটা সময়ে মুগল সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চলের শক্তিকেন্দ্র বাংলা বিহার-উড়িষ্যার ভবিষ্যত নির্মাণের দায়িত্বও এসে বর্তায় মুর্শিদ কুলী খানের উপর। শাসনকার্যে যে ন্যায়পরায়ণতা ও বিচক্ষণতা প্রয়োগ করে দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা স্থাপন করেছিলেন, তাতে দুর্বল দিল্লী-সাম্রাজ্যের কেন্দ্রের প্রতি ততটুকু আনুগত্য তিনি না দেখলেও পারতেন কিন্তু তা তিনি করেন নি।  



কিন্তু অদৃশ্য ভবিতব্য বাংলার এই আপাত সুদিনেও অন্য এক ইতিহাসের সূচনা করছিল মুর্শিদ কুলী খাঁর সময় থেকেই। মুর্শিদ কুলী খাঁর নিয়মিত সুবাদারির আগে পর্যন্ত মুগল প্রশাসনের সকল উচ্চপদেই নিযুক্ত পেতেন আগ্রা ও পাঞ্জাব থেকে আগত, বিশেষ করে মুসলমানরা। তারা নতুন সুবাদারের সঙ্গে বাংলায় আসতেন এবং সুবাদারের বদলির সঙ্গে সঙ্গে সেসব স্থানে ফেরত যেতেন। কিন্তু দিল্লীর দুর্দিনে অবস্থা বদলে গেল। 



তদুপরি, বাংলায় বাণিজ্যরত ইউরোপীয় বণিকেরা তো ছিলই। মুর্শিদ কুলী খাঁর মত যোগ্য শাসকের সময়ে এইসব বণিক ও হিন্দু উচ্চপদস্থ ব্যাক্তিবর্গ বাংলার শাসকের জন্য বিপদের কারণ হয়ে দেখা দেয়নি সত্য, কিন্তু মুর্শিদ কুলী খাঁর মৃত্যুর ৩০ বছর পর দেখা গেল ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীই বাংলার এসব উচ্চপদস্থ হিন্দুর যোগসাজশে বাংলার মুগল তথা মুসলিম শক্তির পতন ঘটিয়ে দিল। 





মুগল শক্তির দেহে অধঃপতন ও ক্ষয়ের এই যে প্রক্রিয়া সম্রাট আওরঙ্গজেবের বিচক্ষণ শাসনের আড়ালে আরম্ভ হয়েছিল এবং যার পরিণামে ধসে পড়েছিল দিল্লী সাম্রাজ্য, কিছুটা দেরিতে হলেও তাই আরম্ভ হলো মুর্শিদ কুলী খাঁর সুশাসনের আড়ালে।

 অসাধারণ প্রতিভাসম্পন্ন নবাব-সুবাদার মুর্শিদ কুলী খাঁ তার যেন দেখেও দেখতে পেল না , ভবিতব্য বুঝি এমনিভাবেই আড়াল থেকে ধ্বংসের শক্তিকে ক্রমে নিয়ে আসে স্পষ্ট দিবালোক। এই অধ্যায়ের শেষের দিকে দেখা যাবে, কি সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েই না সেই ধ্বংস দেখা দিয়েছিল বাংলার ভাগ্যাকাশে। 



পরম ধর্মনিষ্ঠ নবাব-সুবাদার মুর্শিদ কুলী খান জীবনের শেষ দিকে মুর্শিদাবাদের অদূরে নির্মাণ করেন একটি মসজিদ। সেই মসজিদই কাটরার মসজিদ নাম বিখ্যাত। পবিত্র মক্কা মুয়াজ্জমার মসজিদের অনুকরণে নির্মিত এই মসজিদটির সঙ্গে ছিল মিনার, চৌবাচ্চা ও ইন্দারা। তার হুকুমে মসজিদের প্রবেশদ্বারের সোপানাবলীর নিচে একটি প্রকোষ্ঠ নির্মিত হয়। মৃত্যুর পর এই প্রকোষ্ঠেই তাকে সমাহিত করা হয়। 

এই ছিল তার শেষ ইচ্ছা। তিনি বলেছিলেন, নামাজিদের পায়ের ধুলো যেন তার কবরের উপর পরে। মসজিদটি দৈর্ঘ্যে ৮৬/৮৭ হাত, প্রস্থে ১৬ হাতের বেশি। মসজিদ নির্মাণ সমাপ্ত হওয়ার প্রায় ১ বছর পর ১৭২৭ সালে তিনি পরলোকগমন করে। 



আরো পড়ুন :







Amazon









Post a Comment