ইলিয়াস শাহী রাজবংশ : সুলতান  রুকন-উদ-দীন বারবক শাহ (১৪৫৯/৬০-১৪৭৪ সাল )


ইলিয়াস শাহী রাজবংশ : সুলতান  রুকন-উদ-দীন বারবক শাহ










মৃত্যুর পূর্বেই সুলতান নাসির - উদ- দীন উপযুক্ত বয়স্ক পুত্র  বারবক শাহকে রাজ্য শাসন ব্যাপারে উচ্চ-ক্ষমতা দিয়েছিলেন এবং পুত্রকে নিজ নামে মুদ্রা উৎকীর্ণ করার অনুমতি দিয়েছিলেন।সুলতান মাহমুদ শাহ এর মৃত্যুর পর যদিও পুত্র সুলতান রুকন-উদ-দীন  বারবক শাহ মসনদে আরোহন করেন। ''রুকন-উদ-দীন বারবক শাহ বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুলতান তো বটেই। সর্বদেশের ও সর্বকালের নরপতিদের মধ্যে তার একটি বিশিষ্ট স্থান আছে বললেও এর ও অত্যুক্তি হবে না। অথচ এর সম্বন্ধে এতদিন আমার বিশেষ কিছুই জানা ছিল না।





 পরবর্তী কালে লেখা ফার্সী বিবরণগুলিতে বারবক শাহ সম্বন্ধে যে বিবরণ আছে,তা নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর এবং আদৌ নির্ভরযোগ্য নয়। একটি সমসাময়িক ফার্সী গ্রন্থ(ইব্রাহিম কায়ুম ফারুকী রচিত ' শরফনামা ')ও কয়েকটি শিলালিপি থেকে তার সম্বন্ধে সামান্য কিছু সংবাদ পাওয়া যায়। 


এ ছাড়া সংস্কৃত ও বাংলা ভাষায় লেখা কয়েকটি গ্রন্থে বারবক শাহ সম্বন্ধে কিছু তথ্য লিপিবদ্ধ আছে। এই বই গুলির মধ্যে কিছু তার সমসাময়িক। এদের সাক্ষ্যই সবচেয়ে মূল্যবান। কারণ বারবক শাহ যে কত বড় ছিলেন ,তার স্পষ্ট আভাস কেবলমাত্র এদের মধ্য থেকেই পাওয়া যায়। 




বাংলার সুলতানদের মধ্যে কয়েকজনের ক্ষেত্রে দেখা গেছে,তারা দীর্ঘজীবী ছিলেন এবং তাদের রাজত্বের  শেষ দিকে তাদের পুত্ররাও বেশ বয়স্ক ছিলেন। তাই শেষ বয়সে পিতার রাজত্বের সময়েও পুত্রও রাজকার্য সম্পন্ন করেছেন,মুদ্রা প্রচলিত করেছেন ও শিলালিপি খোদাই করেছেন। এর আগে আমরা সুলতান শামস-উদ-দীন ফিরোজ শাহ দেহলবীর আমলে তার রাজত্বকালের মধ্যেই তদীয় পুত্রদের মুদ্রা প্রচলনের দৃষ্টান্ত পেয়েছি।


 ''বারবক শাহ একুশ বছর বা তারও বেশি সময় রাজত্ব করেছেন।৮৬৩ হিজরী থেকে ৮৭৮ হিজরী পর্যন্ত তার মুদ্রা পাওয়া যায়। এর কারণ ঐতিহাসিকেরা ঐ সময়ই তার রাজত্বকাল বলে নির্দিষ্ট  করেছেন।কিন্তু আসলে বারবক শাহ ৮৬৩ হিজরীর কিছু আগে থাকতেই রাজত্ব করেছিলেন এবং ৮৭৮ হিজরীর কয়েক বছর পরেও রাজত্ব করেছিলেন বলে আমরা প্রমান পেয়েছি। বারবক শাহ অন্তত ৮৬০-৮৬৩ অবধি তার পিতার সঙ্গে এবং ৮৭৯-৮৮০ হিজরী অবধি তার পুত্রের সঙ্গে যুক্তভাবে রাজত্ব করেছিলেন।



আরো পড়ুন :







 সম্ভবত নাসির-উদ-দীন মাহমুদ শাহের বংশে এই নতুন প্রথা চালু হয়েছিল যে,রাজার পুত্র যুবরাজ পদে অভিষিক্ত হবার সময় থেকেই  পিতার সঙ্গে যৌথভাবে রাজত্ব করবনে। এবং ঐ সময় থেকেই পিতার মতো তারও নাম মুদ্রা এবং শিলালিপিতে উৎকীর্ণ হবে। হোসেন শাহী বংশেরও এই নিয়ম প্রচলিত ছিল ,হোসেন শাহের জীবিত কালেই তার পুত্র নসরৎ শাহের নামাঙ্কিত মুদ্রা প্রকাশিত হয়েছিল। রাজার মৃত্যুর পর যাতে তার পুত্রদের মধ্যে সিংহাসন নিয়ে সংঘর্ষ না ঘটে সেজন্যই সম্ভবত এই ব্যবস্থা হয়েছিল। 



সুলতান-রুকন-উদ-দীন  বারবক শাহ এর নামের সঙ্গে বাংলার এক অতি বিখ্যাত মুজাহিদের শাহাদাত বরণের কথা জড়িত রয়েছে। সেই মুজাহিদ হযরত শাহ ইসমাইল গাজী। বাংলার দুই জায়গায় রংপুর জেলায় কাঁটাদুয়ারে এবং হুগলি জেলার গড় মান্দারণে শাহ ইসমাইল গাজীর মাজার রয়েছে। সুলতান রুকন-উদ-দীন বারবক শাহ এর অন্যতম প্রধান সেনাপতি ছিলেন এই শাহ ইসমাইল গাজী। কাঁটাদুয়ারে অবস্থিত তার মাজারের খাদিমের নিকট 'রিসালাতুশ শুহাদা ' নামক একটি ফার্সী গ্রন্থ পাওয়া গেছে। তাতে শাহ ইসমাইল গাজী ও সুলতান রুকন-উদ-দীন বারবক শাহ সম্বন্ধে যা লেখা আছে ,তার সংক্ষিপ্তসার নিচে দেওয়া হলো। 








শাহ  ইসমাইল গাজী কোরেশ বংশীয় আরব,মক্কাতে তার জন্ম। যৌবন থেকেই তিনি ছিলেন ধর্মপ্রাণ। নানা বিদ্যায় সুশিক্ষিত হয়ে একদল সঙ্গীসহ তিনি আরব থেকে রওনা হয়ে পারস্যের ভিতর দিয়ে ভারতবর্ষে আসেন এবং সুলতান বারবক শাহের রাজধানী লাখনৌতিতে এসে উপনীত হন। রাজ্যে ছিল ছুটিয়া-পটিয়া নামে এক খরস্রোতা নদী,বর্ষাকালে যার প্রবল বন্যায় মানুষের জীবন ও সম্পত্তি নষ্ট হতো। সুলতান অনেক চেষ্টা করেও এই নদীকে বশে আনতে পারেন নি।





 যতবার বাধা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে ,ততবারই তা পানীতে ভেসে গেছে। এমনি অবস্থায় শাহ ইসমাইল গাজী সুলতানকে জানালেন যে,তিনদিন সময় পেলে তিনি এর প্রতিকার নির্দেশ করতে পারবেন। সুলতান রাজি হলেন। তিন দিন ধরে সঙ্গী-সাথীদের সঙ্গে আলোচনা শেষে শাহ সাহেব ছুটিয়া-পটিয়ার উপর এক সেতু বা বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা তৈরী করলেন। তদানুযায়ী সেতু তৈরী করা সম্ভব হল.সুলতান খুশি হয়ে শাহ সাহেবকে সম্মানিত করলেন এবং তার উপর সৈন্য পরিচালনার কঠিন দায়িত্ব অর্পণ করলেন।





 

'রিসালাতুশ শুহাদা'র বর্ণনা মতে শাহ ইসমাইল গাজী উড়িষ্যায় রাজা গজপতিকে পরাজিত করে গড় মান্দারণ দুর্গ দখল করেন।অতঃপর তিনি কামরূপের রাজা কামেশ্বরকেও পরাজিত করেন।এসব বিজয়ের দরুন তার প্রতি  সুলতানের সন্তুষ্টি এবং নিঃস্বার্থ জনসেবার জন্য এই ইসলাম প্রচারক সাধক পুরুষটির প্রতি সুপন্ডিত সুলতানের অনুরক্তি কোন কোন দরবারী ও উচ্চপদস্থ কর্মচারীকে ঈর্ষার্ন্বিত করে তোলে।






 সুলতানের এক হিন্দু সেনাপতি ঘোড়াঘাটের সীমান্ত দুর্গের অধ্যক্ষ ভান্দসী রায় এই ইসলাম প্রচারকের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণের উদ্দেশ্যে এক চক্রান্ত করেন।সুলতান কে তিনি বোঝাতে সক্ষম হন যে ,শাহ ইসমাইল গাজী কামরূপের পরাজিত রাজার যোগসাজশে একটি স্বাধীন  রাজ্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালাচ্ছেন। তদানুযায়ী সুলতান গাজী সাহেবের শিরোচ্ছেদ করার জন্য একদল সৈন্য পাঠান। সুলতানের হুকুম পালিত হয়। শাহাদাত বরণ করেন বীর মুজাহিদ শাহ ইসমাইল গাজী। কথিত আছে,শহীদ গাজী সাহেবের কর্তিত মস্তকটি কাঁটাদুয়ারে এবং মস্তকবিহীন ধড়টি গড় মান্দারনে সমাহিত করা হয়। সুলতান পরে ভান্দসী রায়ের চক্রান্তের কথা জানতে পেরে খুবই দুঃখিত এবং অনুতপ্ত হন। 





হযরত শাহ ইসমাইল গাজী শাহাদাতের পর যে মর্যাদা ও সন্মান অর্জন করেছেন তা সত্যিই অসামান্য। আর এই মর্যাদা ও সন্মান তিনি অর্জন করে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে। ''কাঁটাদুয়ার ও মান্দারনে হযরত শাহ ইসমাইল গাজীর সমাধি শুধু মুসলমানের নয়,হিন্দুরও তীর্থস্থান হিসেবে পরিণত হয়েছিল।এই দুই সমাধি আজ পর্যন্ত বর্তমান আছে। মধ্যযুগের বহু মঙ্গলকাব্যের দিকবন্দনা পালায় কবিরা বিভিন্ন দেবদেবীর বন্দনা করার সময়ে পীর ইসমাইলেরও বন্দনা করেছেন। ইসমাইল গাজীর  কাহিনী নিয়ে কোন কোন কবি কাব্য রচনা করেছেন,তাদের মধ্যে একজন গোরক্ষবিজয় রচয়িতা শেখ ফয়জুল্লাহ। 






সুলতান বাবারক শাহ মিথিলা বা ত্রিহুত অধিকার করেছিলেন বলে জানা যায়। তাছাড়া ত্রিপুরার রাজমালা গ্রন্থ অনুসারে তিনি ত্রিপুরার তরুণ রাজা রত্নফাকে নিজ রাজ্যের অধিকার লাভ সাহায্য করেছিলেন। রত্নফা ত্রিপুরার রাজা হলেন ;গৌড়েশ্বরকে তিনি বড় বড় হাতী ধরে উপহার দিলেন এবং গৌড়েশ্বর তার নাম দিলেন 'রত্নমাণিক্য'। তখন থেকে ত্রিপুরার রাজাদের নামের সঙ্গে 'মাণিক্য ' শব্দ  করার প্রথা প্রবর্তিত হল। 






কেবলমাত্র যুদ্ধবিগ্রহে সাফল্য লাভ এবং রাজ্য জয়েই বারবক শাহের কীর্তি সীমাবদ্ধ নয়। "বারবক শাহ নিজে ছিলেন মহাপন্ডিত। তার বিভিন্ন শিলালিপিতে তার নাম এবং বিভিন্ন  রাজকীয় উপাধীর সঙ্গে আরও দুটি উপাধি যুক্ত দেখা যায়,-অল-ফাজিল এবং অল-কামিল। 








কিন্তু বারবক  শাহ শুধুমাত্র নিজে পান্ডিত্য অর্জন করেই সন্তুষ্ট ছিলেন না,তিনি অন্যান্য পন্ডিতদের পৃষ্ঠপোষণ করতেন। শুধু পন্ডিত নয় , কবিরাও তার পৃষ্ঠপোষণ লাভ করতেন। আর কেবল মাত্র মুসলমান কবি-পন্ডিত নয় হিন্দু কবি-পণ্ডিতদের উপরও তিনি  দাক্ষিণ্য বর্ষণ করতেন।তার পৃষ্ঠপোষিত কবি-পন্ডিতদের মধ্যে এমন কয়েকজন রয়েছেন, শত শত বছর ব্যাবধানেও  যাদের খ্যাতি অম্লান রয়েছে।





 এই কবি-পন্ডিতদের মধ্যে ছিলেন 'বিশারদ' বৃহস্পতি মিশ্র রায়মুকুট ,মালাধর বসু ,কৃত্তিবাস ,রাজকবি আমীর জৈনুদ্দিন হারাওয়ী,আমীর সাহাবুদ্দিন হাকিম কিরমানী,কবি মনসুর সিরাজী ,কবি মালিক ইউসুফ  বিন হামিদ প্রমুখ। শিল্প ,সাহিত্য ,সংস্কৃতির পরিমণ্ডলে যেমন প্রশাসন পরিমণ্ডলেও হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকল প্রতিভার সমাবেশ ঘটেছিল। 





সুলতান বারবক শাহর উৎকীর্ণ মুদ্রা ও শিলালিপি এত বিভিন্ন  স্থানে পাওয়া গেছে ,যার থেকে বোঝা যায়,তার রাজ্যের আয়তন কত বিশাল ছিল। উত্তরবঙ্গ ,পূর্ববঙ্গ ,দক্ষিণবঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গের অধকাংশ এবং বিহারের কতকাংশ ছিল তার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত।  'রিসালাতুশ শুহাদা'র সাক্ষ্য অনুসারে বারবক শাহর রাজ্যের উত্তর-পূর্ব সীমান্ত ছিল ঘোড়াঘাট। 





''বারবক শাহ যার রাজ্যের আয়তন ছিল  সুবিশাল,যিনি নানা রাজ্য জয় করেছিলেন,যিনি নিজে বিদ্বান ছিলেন ,বিদ্বান ও সাহিত্যিকদের যিনি পৃষ্ঠপোষণ করতেন,যার মনোভাব ছিল উদার এবং অসাম্প্রদায়িক অসাম্প্রদায়িক এবং যিনি ছিলেন একজন সত্যকার সৌন্দর্যরসিক তার সম্বন্ধে যে আমরা বিশেষ কিছু জানি না ,এ অত্যন্ত দুঃখ ও লজ্জার বিষয়।বারবক  শাহের মত একাধারে এতগুলি বৈশিষ্টের সমাবেশ আর কোন রাজার মধ্যেই দেখা যায়নি। পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্ষিত বারবক শাহের পূর্বোক্ত শিলালিপিতে আরবী কবিতায় তার  যে প্রশস্তি রয়েছে তার মধ্যে বিশেষ অতিরঞ্জন নেই।  







সুলতান বারবক শাহ আট হাজার আবিসিনয়কে তার সেনাদলে এবং  প্রশাসনে নিযুক্ত করেছিলেন। কালক্রমে তাদের অনেকেই রাজ্যের উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হন। পরে প্রমাণিত হয় যে,এমনটি করা ছিল সুলতান বারবক শাহ এর আত্মঘাতী এক পদক্ষেপ।   


আরো পড়ুন :



ইলিয়াস শাহী রাজবংশ : সুলতান নাসির-উদ-দীন মাহমুদ শাহ

 







Post a Comment