মুর্শিদাবাদ নাজিমী আমল : প্রারম্ভিক সূচনা (১৭৬৫-১৮৫৪ সাল) 




মুর্শিদাবাদ নাজিমী আমল : প্রারম্ভিক সূচনা





প্রারম্ভিক সূচনা 


''হিন্দু, মুসলমান এবং ইংরাজ সকলেই মীর জাফরের কথা আলোচনা করিয়া থাকেন। পাঁচশত বৎসর মুসলমানের সম্মুখে কুর্নিশ করিতে করিতে হিন্দু-সন্তানের পক্ষে মুসলমান-শাসন অভ্যস্ত হয়ে উঠিয়াছিল; তাহারা কেহ রাজা, কেহ মন্ত্রী, কেহ সেনাপতি হইয়া, মুসলমানের দোহাই দিয়া, শাসন ও শোষণকার্য্য হস্তগত করিয়াছিলেন। সিরাজদ্দৌলা তাহার মূলোচ্ছেদের চেষ্টা করায়, সকলে মিলিয়া মীর জাফরের সহায়তায় সিরাজদ্দৌলা উচ্ছেদ সাধন করেন; সুতরাং হিন্দু কখনও মীর জাফরের কথা বিস্মৃত হইতে পারিবেন না। 




মুসলমান অনেক দিনের নবাব। কি ইংরাজ, কি বাঙালি, সকলেই সে নবাব দরবারে জানু পাতিয়া উপবেশ করিতেন।  যে নিতান্ত নগন্য মুসলমান, তাহার পদভারেও মেদিনী কম্পিত হইয়া উঠিত। মীর জাফরের ব্যবহার গুণেই মুসলমানের সে পূর্ব গৌরব বিনষ্ট হইয়া গিয়াছে। সুতরাং মুসলমানও মীর জাফরের কথা বিস্মৃত হইতে পারেন নাই।  



Bohubrihi online courses





ইংরাজ-রাজ্যের ন্যায় মুসলমান-রাজ্যেও প্রতিভার সমাদর ছিল। সেই সমাদর লাভ করিয়া কত নগণ্য লোকে ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হইয়াছেন। মুরশিদ কুলী খ এইরূপ একজন নগণ্য লিক; জাতিতে ব্রাহ্মণ, ধর্মে মুসলমান, অবস্থায় ক্রীতদাস। শিক্ষায় স্বাভাবিক প্রতিভা সমুজ্জ্বল হইয়াছিল বলিয়া, তিনি সম্রাট আওরঙজীবের আদেশে হায়দরাবাদের প্রধানমন্ত্রী পদে নিযুক্ত হইয়াছিলেন। 

এই সময়ে খোরাসান দেশের আফসার বংশীয় সুজাউদ্দিন খা নামক আর একজন প্রতিভাশালী তরুণ যুবক হায়দরাবাদে বাস করিতেন। কুলী খাঁর একমাত্র কন্যার সঙ্গে সেই তরুনের বিবাহ হইয়াছিল। 

উত্তরকালে মুর্শিদ কুলী বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা নবাব-নাজিমপদে নিযুক্ত হইলে, জামাতা সুজা খা সুবা উড়িষ্যার শাসনভার প্রাপ্ত হইয়াছিলেন; তাহার পদোন্নতির সন্ধান লাভ করিয়া, তাহার আত্নীয় কুটুম্বগণও উড়িষ্যায় উপনীত হইয়াছিলেন। এইরূপে মির্জা মহম্মদ নামক এক দরিদ্র কুটুম্ব আসিয়া সুজা খাঁর সহিত মিলিত হইবার প্রমান প্রাপ্ত হওয়া যায়। 



Amazon



মিরজা মহম্মদের দুই পুত্র হাজি আহম্মদ এবং আলীবর্দী। উভয় পুত্রই বিদ্যাবুদ্ধি ও তীক্ষ্ণ প্রতিভায় বাংলায় বাংলার ইতিহাসে বিবিধ কীর্তি-কাহিনী সংযক্ত করিয়া গিয়াছেন। আলিবর্দির পুত্রসন্তান ছিল না; তিনি তিন কন্যাকে ভ্রাতা হাজি আহম্মদের তিন পুত্রের সহিত বিবাহ দিয়া, দৌহিক সিরাজদ্দৌলা পোষ্যপুত্ররূপে গ্রহণ করিয়াছিলেন। 

হাজি আহম্মদের জামাতা আলাউল্যা এবং ভগিনীপতি মীর জাফর খা এই সময় হইতে আলিবর্দীর কণ্ঠলগ্ন হন। আতাউল্যার কথা অনেকেই বিস্মৃত হইয়াছেন; কিন্তু মীর জাফরের কথা চিরস্মরণীয় হইয়া রহিয়াছে। এখানে উল্লেখ্য যে, নবাব অলিওয়ার্দীর অনুগ্রহপুষ্ট বৈমাত্রেয় ভগ্নিপতি মীর জাফর আলী খান এবং ভ্রাতুষ্পুত্রীর স্বামী আতাউল্লাহ খান বর্গীর হাঙ্গামাকালে নবাব অলিওয়র্দীকেই হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিলেন।

 ''আলীবর্দীর সুকৈশলে তাহা জয়যুক্ত হয় নাই। আলীবর্দীর সময়ে যাহা বিফল হইয়া গিয়েছিল, সিরাজদ্দৌলার সময়ে তাহাই সফল হইল। মীর জাফর কর্নেল ক্লাইভের হাত ধরিয়া একবার মাত্র তখত মোবারকে পদার্পন করিলেন; কিন্তু তাহাতে আর অধিক দিন উপবেশন করিতে পারিলেন না। 

মীর জাফর আলী খান বাংলার মসনদ পেয়েছিলেন দু'বার , প্রথমবার ১৭৫৭ থেকে ১৭৬০ সাল, আর দ্বিতীয়বার ১৭৬৩ থেকে ১৭৬৫ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত। ১৭৬৫ সালের জানুয়ারিতেই দুরারোগ্য কুষ্ঠোব্যাধিতে অনেক কষ্টের পর পরলোকগমন করেন। ''জাফরগঞ্জ সিরাজের বধ্যভুমি; বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার স্বাধীনতার সমাধি। 

এই স্থানের ভূমি বিশ্বসঘাতকের তরবারির  আঘাতে কলুষিত হইয়াছিল, তাই যে ভবনে সেই শোচনীয় হত্যাকান্ড সম্পাদিত হয়, মুর্শিদাবাদবাসীগণ আদ্যপি তাহাকে 'নেহকহারামী দেউড়ি' কহিয়া থাকে। যাহার অন্নে, যাহার গৃহে প্রতিপালিত হইয়া, বিশ্বাসঘাতকগণ সংসারে সুপরিচিত হইয়াছিল।

 আপনাদিগের বাসভবনে তাহারই রক্তপাতের দ্বারা কৃতজ্ঞতার পরিচয় প্রদান করিয়াছিলেন, যে গৃহে সেই শোচনীয় হত্যাকান্ড সংসাধিত হইয়াছিল, সে গৃহ চূর্ন-বিচূর্ণ হইয়া অণুপরমাণুতে মিশিয়া গেলেও, তাহার স্থানের লোপ হয় নাই। আজও সেই স্থানে উপস্থিত হইলে, বিশ্বাসঘাতকগণের প্রতি আন্তরিক ঘৃণা ও হতভাগ্য সিরাজের প্রতি সহানুভূতির উদয় হইয়া থাকে। জাফরাগঞ্জ আবার বঙ্গের শেষ নবাব-নাজিমগণের সমাধিভবন। 


জানা মতে, নবাব মীর জাফর আলী খানের তিন স্ত্রী। প্রথম স্ত্রী বেগম শাহ খানম নবাব অলিওয়ার্দী খানের বৈমাত্রেয় ভগিনী। মীর জাফর পুত্র মীরণ হচ্ছেন শাহ খানমেরই গর্ভজাত পুত্র। মীর কাশেম শাহ খানমের গর্ভজাত কন্যার স্বামী। মীর জাফরের অন্য দুই স্ত্রী হচ্ছেন মণি বেগম ও বিব্বু বেগম। মণি বেগম ও বিব্বু বেগম উভয়েই অপেক্ষাকৃত সাধারণ ঘরের কন্যা। তিন স্ত্রীর মধ্যে মণি বেগমই ছিলেন মীর জাফরের প্রিয়তমা বেগম। 

নবাব-নাজিম নজম-উদ-দৌলাহ (১৭৬৫-১৭৬৬ সাল)

নজম-উদ-দৌলাহ বাংলার প্রথম নবাব-নাজিম। মুহম্মদ রেজা খা নিযুক্ত হন নায়েব-ই-সুবা হিসাবে। নবাব-নাজিমের বার্ষিক বৃত্তি ইংরেজ কোম্পানি কর্তৃক নির্ধারিত হয় ৫৩, ৮৬, ১৩১ টাকা নয় আনা। একেবারে টাকা-আনা-পাইয়ের নিখুঁত হিসাব! তার মধ্যে ১৭, ৭৮, ৮৫৪ টাকা এক আনা 'নবাব'- এর নিজ ব্যয় নির্বাহের জন্য এবং বাকী টাকা সৈন্য-সামন্তদের ব্যয় নির্বাহের জন্য।

 রবার্ট ক্লাইভ নজম-উদ-দৌলার সঙ্গে মিলিতভাবে মতিঝিলে 'কোম্পানি-রাজ্যের' প্রথম পুণ্যাহ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেন। তার কিছুদিন পর ১৭৬৬ সালের ৮ই মে তারিখে পরলোকগমন করেন বাংলার প্রথম নবাব-নাজিম নজম-উদ-দৌলাহ। 


Bohubrihi online courses



নবাব-নাজিম সৈফ-উদ-দৌলাহ (১৭৬৬-১৭৭০ সাল)

মীর জাফর-মণি বেগমের প্রথম পুত্র নজম-উদ-দৌলার মৃত্যুর পর বাংলার পরবর্তী নবাব-নাজিম নিযুক্ত হলেন মীর জাফর-মণি বেগমের দ্বিতীয় পুত্র সৈফ-উদ-দৌলাহ। মীর কানাইয়া নামেই তিনি পরিচিত ছিলেন। সৈফ-উদ-দৌলার সময় নিজামতের বৃত্তি কমে গিয়ে ৪২,৮৬,২৩২ টাকায় নির্দিষ্ট হয়। 

মতিঝিলে পুণ্যাহ অনুষ্ঠানে এবারে সৈফ-উদ-দৌলার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন গভর্নর ভেলের্স্ট। বাংলার সেই ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সময় ১৭৭০ সালে, সৈফ-উদ-দৌলা বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।  


আরো পড়ুন :






amazon






Post a Comment