''জাফর আলী খা নবাব হইয়া প্রথমতঃ সিরাজউদ্দৌলার হীরাঝিলে বা মনসুরগঞ্জের প্রাসাদে বাস করিয়াছিলেন, পরে মুর্শিদাবাদ কেল্লামধ্যে আলীবর্দী খাঁর প্রাসাদে আসিয়া বাস করেন।
নবাব হইয়া তিনি স্বীয় জ্যেষ্ঠপুত্র জাফরগঞ্জের প্রাসাদ প্রদান করেন, তদবধি মীরণের বংশধরেরা জাফরগঞ্জের প্রাসাদেই বাস করিতেছেন। জাফরগঞ্জ মুর্শিদাবাদ নগরের মধ্যস্থলে অবস্থিত। সিরাজের বধ্যভূমি জাফরগঞ্জ প্রাসাদের উত্তর-পূর্ব কোণে। বধ্যভূমিজাত নিম্ববৃক্ষটি সদর রাস্তা হইতে দেখিতে পাওয়া যায়। জাফরাগঞ্জের বর্তমান নবাব ফয়জালি বা মেহেদী হোসেন খা মীরণের বৃদ্ধ প্রপৌত্র নবাব আজম আলী খাঁর পুত্র। জাফরাগঞ্জের নবাবের গভর্মেন্টের নিকট হইতে বাৎসরিক ৬০ হাজার টাকা বৃত্তি পাইয়া থাকেন। মীরণের দেহ রাজমহলে সমাহিত করা হয়।
এখানে স্মরণযোগ্য যে, জাফরাগঞ্জে রয়েছে যেমন মীর জাফর বংশীয়দের সমাধিভবন, তেমনি খোশবাগে রয়েছে নবাব অলিওয়ার্দী বংশীয়দের ও নবাব সিরাজের সমাধিসমূহ। সিরাজ বেগম লুৎফুন্নিসা এই খোশবাগেরই তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত হয়ে কন্যা উম্মে জোহুরাসহ সেখানে বসবাস করতেন। নবাব সিরাজের বেগম ও কন্যার জন্য মাসিক ভাতা ছিল ১০০ টাকা এবং খোশবাগ সমাধিভবনের ও তৎসংলগ্ন মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মাসিক ৩৫০ টাকা। বেগম লুৎফুন্নিসার মৃত্যুর পর তার কন্যা উম্মে জহুরার বংশীয়রাও পেন্সন পেতেন খুবই সামান্য।
সিরাজ বেগমের জন্যই মাসিক ১০০ টাকা, তার কন্যা- বংশীয়দের জন্য আর কত হবে। সিরাজ-দুহিতা উম্মে জহুরার চার্ কন্যা , শরীফুন্নিসা, অসমতুন্নিসা, সাকিনা ও উম্মে মেহেদী বেগম। সিরাজ বেগম ও সিরাজ দুহিতার মৃত্যুর পর নবাব সিরাজের এই চার্ দৌহিত্রী ''খোশবাগ প্রভৃতির তত্বাবধানের জন্য ওয়ারেন হেস্টিংসের নিকট প্রার্থনা করিয়াছিলেন।
তাদের মৃত্যুর হইলে উক্ত বংশীয়রা খোশবাগের তত্বাবধানের ভার পাইয়াছিলেন। ১৮৪৫ সালে সকিনার জ্যৈষ্ঠ কন্যা খয়রুন্নেসার কন্যা জীনা বেগম ও তাহার কনিষ্ঠা কন্যা ফাতেমার পুত্র মুহম্মদ আলী খা এবং উম্মত জায়েনা ও উম্মত কোনসুম বেগম নামে উক্ত বংশীয় আরও দুইজন মহিলা এই চারজন খোশবাগের মোতয়ালী নিযুক্ত হইয়াছিলেন।
ক্রমে উক্ত বংশীয়গণের হস্ত হইতে গভর্মেন্ট স্বয়ং সে ভার গ্রহণ করে। সমাধিগৃহে দ্বীপ জ্বলিবার জন্য এক্ষণে মাসে চারি আনা মাত্র তৈলের ব্যবস্থা হইয়া থাকে। মাসে চার আনা মানে বার্ষিক তিন টাকা। মীরজাফর বংশীয়দের ভাতা বার্ষিক ৬০ হাজার টাকার সঙ্গে নবাব অলিওয়ার্দী বংশীয় এবং নবাব সিরাজ বংশীয়দের সমাধি ভবনের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ বার্ষিক ৩ টাকাকে তুলনা করে দেখা যেতে পারে। হিসাবটা বাংলা ১৩১৬ সালের।
১৯১০ সালের দিকে প্রকাশিত গ্রন্থ 'মুর্শিদাবাদ কাহিনী'তে শ্রিনিখিলনাথ রায় লিখেছেন যে, আজও অর্থাৎ ১৯১০ সালেও বেগম লুৎফুন্নিসার কন্যা উম্মে জহুরার বংশীয়দের মালবার বেগম ও জাফর কুলী খাঁ নামক দুইজন জীবিত আছেন। (সম্প্রতি কিছু আগে মরহুম ফজলে লোহানী 'যদি কিছু মনে করেন' অনুষ্ঠানে সেই বংশীয় একজনকে বাংলাদেশে টেলিভিশনে দর্শক-শ্রোতাদের সামনে উপস্থিত করেছিলেন।
নবাব-নাজিম মোবারক-উদ-দৌলাহ (১৭৭০-১৭৯৬ সাল)
মীর জাফর-মণি বেগমের আর কোন পুত্র না থাকায় এবারে বাংলার নবাব-নাজিম নিযুক্ত হলেন মীর জাফর-বব্বু বেগমের পুত্র মোবারক-উদ-দৌলাহ। তার আগেকার দুই নবাব-নাজিমের অভিভাবিকা হিসেবে বৃত্তি গ্রহণ করতেন তাদের না মণি বেগম। সেই নিয়ম অনুসারে বালক নবাব-নাজিম মোবারক-উদ-দৌলাহ অভিভাবিক হিসাবে বৃত্তি পাওয়ার কথা ছিল রব্বু বেগমের। কিন্তু নানারকম কারসাজির মাধ্যমে এবারও মোবারক-উদ-দৌলার অভিভাবিক থেকে গেলেন মণি বেগমই।
তবে মোবারক-উদ-দৌলার সময়ে নিজামতের জন্য নির্দিষ্ট টাকা আরও কমে গিয়ে দাঁড়াল ৩১,৮২,৯৯১ টাকায়। পরবর্তীতে আরও কমে গিয়ে দাঁড়ায় ১৬ লক্ষ টাকায়। নবাব-নাজিম মোবারক-উদ-দৌলার সময়ে নবাবের দেওয়ান নিযুক্ত হন মহারাজা নন্দকুমারের পুত্র রাজা গুরুদাস। ১৭৯৬ সালে মৃত্যুমুখে পতিত হন নবাব-নাজিম মোবারক-উদ-দৌলা।
নবাব-নাজিম বাবর জং (১৭৯৬-১৮১০ সাল)
নবাব-নাজিম বাবর জং ছিলেন মোবারক-উদ-দৌলার পুত্র।তিনি দিলার জং উপাধি গ্রহণ করেছিলেন। ১৮১০ সালে তিনি পরলোক গমন করেন।
নবাব-নাজিম আলিজা বা সৈয়দ জৈনুদ্দীন আলী খা (১৮১০-১৮২১ সাল)
ইনি নবাব-নাজিম বাবর জঙ্গের পুত্র। ১৮২১ সালে তার মৃত্যু হয়।
নবাব-নাজিম ওয়ালাজা (১৮২১-১৮২৫ সাল)
নবাব-নাজিম ওয়ালাজা নবাব-নাজিম আলিজার ছোট ভাই। তিনি মারা যান ১৮২৫ সালের প্রথম দিকে।
নবাব-নাজিম হুমায়ূনজা (১৮২৫-১৮৩৮ সাল)
নবাব-নাজিম হুমায়ূনজার সময়ে মুর্শিদাবাদের পুরনো প্রাসাদের স্থলে নতুন প্রাসাদ নির্মিত হয়। এই নির্মাণ কাজে ৯ বছরেরও বেশি সময় লেগেছিল। ১৮৩৭ সালে এর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়। এই কাজে খরচ হয়েছিল প্রায় ১৭ লক্ষ টাকা হুমায়ুনজা পরলোক গমন করেন ১৮৩৮ সালে।
Post a Comment