বাংলা সালতানাত: আফগান শাসন আমল (১৫৩৯-১৫৭৫ সাল) পর্ব ০১ 


বাংলা সালতানাত: আফগান শাসন আমল





'মুসলিম বাংলা সাহিত্য' গ্রন্থের ৮৯ পৃষ্ঠায় ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক বলেন - ''ইহা হইতে দেখা যায়, শেখ ফয়জুল্লাহ ১৪৬৭ কিংবা ১৪৯৭ শকাব্দে 'সত্যপীর' রচনা করেন। সুতরাং ১৫৪৫ বা ১৫৭৫ খ্রিষ্টাব্দে সত্যপীরের রচনা।''  





এই দ্বন্দ্বকালের প্রারম্ভে রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে প্রধান চরিত্র তিনটি: বিশাল বাংলার সুলতান মাহমুদ শাহ পাঠান বীর শের খান ও দিল্লির বাদশা হুমায়ুন। এদের মধ্যে একটি বিশাল রাজ্যের অধীশ্বর ছিলেন মাহমুদ শাহ খুব বড় না হলেও একটি সম্রাজ্য ছিল বাদশা হুমায়ুনের, আর রাজ্যহীন ছিলেন পাঠান বীর শের খান।


 শের খান ছিলেন বিহারের সুলতান-পুত্র জালাল খানের শিক্ষক। তিনটি চরিত্রের মধ্যে সবচাইতে বুদ্ধিমান ও ধুরন্ধর ছিলেন শের খান, সবচাইতে শরীফ স্বভাবের অধিকার ছিলেন হুমায়ুন, আর সবচাইতে নির্বোধ ছিলেন মাহমুদ শাহ। 




শের খান বাংলা আক্রমণ করতে আসছেন শুনে পর্তুগীজদের সাহায্যে বলিয়ান হয়ে মাহমুদ শাহ তেলিয়াগড়ে শের খানকে মুকাবিলা করলেন। শের খান বুঝলেন, পর্তুগীজদের পরাস্ত করা সম্ভব না। আবার তেলিয়াগড়ে যুদ্ধে বেশি দিন জড়িয়ে থাকলে বাদশা হুমায়ুনের দিক থেকে বিপদ বাড়বে। 



কারণ এর মধ্যেই হুমায়ুন পরাস্ত করেছেন গুজরাট সুলতানকে এবং যেকোন সময় তিনি ছুটে আসবেন শের খানের অধিকৃত এলাকা ছিনিয়ে নিতে। হুমায়ুনের মুঘল বাহিনীকে মুকাবিলা করা তার পক্ষে সহজ হবে না। তাই শের খান নিজ পুত্রকে তেলিয়াগড়ের যুদ্ধে লিপ্ত রেখে নিজে তার বাহিনীসহ গোপনে ছুতে এসে উপস্থিত হলেন বাংলার রাজধানী গৌড়ে। খবর পেয়ে মাহমুদ শাহ তো হতবাক।



 তখনই দেন তিনি নির্বুদ্ধিতার পরিচয়। পর্তুগীজদের নিষেধ সত্ত্বেও মাহমুদ শাহ বীরের মত শের খানকে আক্রমণ না করে ১৩ লক্ষ্য স্বর্ণমুদ্রা উপহার দিয়ে শের খানকে বিহারে ফিরে যেতে রাজি করান। শের খান বিহারে ফিরে গিয়ে মাহমুদ শাহর প্রদত্ত অর্থে সেনাবাহিনীকে আরও শক্তিশালী করে মাহমুদ শাহর বিরুদ্ধে চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন। 






আক্রান্ত হলো বাংলার রাজধানী। পালালেন মাহমুদ শাহ। ওদিকে চুনার দুর্গ জয় করে বাদশা হুমায়ুন বাংলার পথে অগ্রসরমান। শের খান বাদশার কাছে দূত পাঠালেন সন্ধির আশায়। বাদশার কাছে দূত পাঠালেন মাহমুদ শাহও। তিনি শের খানকে দমন করার জন্য বাদশা হুমায়ুনকে অনুরোধ জানান। বাদশার দুর্ধর্ষ মুঘল বাহিনী ছুতে চলল গৌড়ের পথে। সঙ্গে মাহমুদ শাহ। কিন্তু খলগাও নামক স্থানে এলে মাহমুদ শাহ তার দুই ছেলের মর্মান্তিক মৃত্যু সংবাদ পেয়ে শোকে দুঃখে মৃত্যুমুখে পতিত হন। 



ইতিমধ্যে শের খান গৌড়ে রক্ষিত বিপুল ধন-সম্পদ হস্তগত করে তা রোহতাস দুর্গে স্থানান্তরিত করেন এবং গৌড় ত্যাগ করে চলে যান। ১৫৩৮ সালের জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে বাদশা হুমায়ুন গৌড়ে প্রবেশ করেন। সেখানে আরাম-আয়েশের মধ্যে দিয়ে কাটিয়ে দেন দীর্ঘ নয় মাস। এর মধ্যে শের খান নিজেকে আরও শক্তিশালী করে নিয়ে বেনারস দখল করে নেন। 


দখল করে নেন জৌনপুর ইন চুনার দুর্গ। এই খবরে অপেক্ষাকৃত সরলমনা বাদশা হুমায়ুন প্রমাদ গনলেন। আবার যে শেরখানের দিল্লী-আগ্রা আক্রমণের পালা। তিনি ত্বরিতে গৌড় ত্যাগ করে রাজধানীর পথে অগ্রসর হলেন। কিন্তু শের খান তাকে প্রতিরোধ করে দাঁড়ান চৌসারে। গৌড় ত্যাগ করার মুহূর্তে মুগল বাদশা বাংলার শাসনকর্তা নিয়োগ করে করে যান জাহাঙ্গীর কুলী বেগকে। 

বিশ্ব সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে জানতে ঘুরে আসুন বাংলার পাঁচ মুক্ত সাহিত্যকোষে থেকে । 

                জাহাগীর কুলি বেগ (১৫৩৯-১৫৪০সাল)



বাংলার শাসনকর্তা জাহাগীর কুলী বেগের অধুনা তখন পাঁচ হাজার সৈন্য এবং কিছু সংখ্যক অমাত্য। চৌসারে শের খান বাদশা হুমায়ুনকে পরাজিত করে কনৌজ পর্যন্ত পুরো এলাকায় নিজ আধিপত্য বিস্তারে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন এবং হাজী খান বাতেনী ও জালাল বিন জলুকে গৌড় আক্রমণ করতে পাঠালেন। 



যুদ্ধে স্বল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়ে জাহাগীর কুলী পাঠান বাহিনীর মুকাবিলা করে পরাস্ত ও নিহত হলেন। এর আগে শের খান শেরগড দুর্গে মসনদে আরোহণ করে নিজ নামে মুদ্রা জারি করেছেন এবং উপাধি গ্রহণ করেছেন আল-সুলতান আল-আদেল ফরীদ আল-দুনিয়া ওয়াল-দীন আবুল মুজাফ্ফর শের শাহ আল-সুলতান।


 তারপর ১৫৪০ সালে কনৌজের যুদ্ধে হুমায়ুনকে পরাজিত করে শের শাহ দিল্লীর মসনদে আরোহন করেন। বাংলা পরিণত হয় দিল্লী সম্রাজ্যের একটি প্রদেশ। সেও প্রদেশের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন খিজির খানকে। 




                        খিজির খান (১৫৪০-১৫৪১সাল)


বাংলার খিজির খানের শাসনকর্তৃত্ব বজায় থাকে মাত্র এক বছরের মত। এর মধ্যেই তিনি বিদ্রোহাত্নক কার্যকলাপ আরম্ভ করেন। তিনি মরহুম মাহমুদ শাহর কন্যাকে বিয়ে করে সুলতান শের শাহর বিরাগভাজন হন এবং কঠোর শাস্তি পেয়ে বাংলার শাসন কর্তৃত্ব থেকে অপসারিত হন। 




শের শাহ তখন বাংলাকে কয়েকটি ছোট ছোট শাসনতান্ত্রিক এলাকায় বিভক্ত করেন। এই এলাকা সমূহের শাসনকর্তারা ছিলেন পস্পরের মধ্যে স্বাধীন এবং সকলেই দিল্লীর অনুগত। দিল্লীর সুলতান নিজেই তাদেরকে নিযুক্ত করতেন এবং তারা সুলতানের নিকট তাদের কাজের জন্য দায়ী থাকতেন। 

এই ব্যবস্থায় বাংলার বিদ্রোহ সমস্যা দূরীভূত হয়। সুলতান শের শাহর সময়ে ১৫৪২/৪৩ সালে বাংলায় বারবক শাহ নামধারী একজন সুলতান রাজত্ব করেন। শের শাহর রাজত্বের মধ্যেভাগে ইনি বিদ্রোহ করে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। মনে হয় তার স্বল্পকালীন রাজত্ব ছিল ময়মনসিংহ ও সিলেট অঞ্চলে। সে যাক,শের শাহ কর্তৃক বাংলাকে কয়েকটি বিভাগে বিভক্ত করার ফলে বাংলার জন্য কোন একক শাসনকর্তার নাম পাওয়া যায় না। 


এমনি অবস্থা চলে ১৫৪৫ সাল পর্যন্ত। ঐ সালে সুলতান শের শাহর মৃত্যুর পর শের শাহর পুত্র জালাল খান সুলতান ইসলাম শাহ সূর উপাধি গ্রহণ করে দিল্লীর মসনদে আরোহন করেন। বাংলা শাসনের ব্যাপারে পিতার ব্যবস্থা তিনি বাতিল করে বাংলাকে একক শাসন কর্তৃত্বে আনয়ন করেন। শামস-উদ-দীন মুহম্মদ সূর নামক এক আত্মীয়কে তিনি বাংলার শাসনকর্তা নিযুক্ত করে। 


আরো পড়ুন :

















Post a Comment