শাহ-ই -বাঙ্গালা:একীভূত  স্বাধীন বাঙ্গালা সালতানাত (১৩৫২-১৫৩৮)



শাহ-ই -বাঙ্গালা

  বাংলার মুসলমান কবিগনের মধ্যে শাহ মুহম্মদ সগীরাই প্রাচীনতম।সুলতান গিয়াস উদ-দীন আজম  শাহ এর রাজত্বকালে তিনি রচনা করেন "ইউসুফ-জুলিখা 'কাব্য। কবির রাজ-বন্দনার অংশ বয়স বিশেষ নিচে মূল বানানেই উদ্ধৃত হলো। 

       

রাজ রাজস্বর মৈদ্ধে ধার্মিক পন্ডিত। 

      দেব অবতার নির্প জগত বিদিত 

     মনুষ্যের মৈদ্ধে  যেহ্ন  ধৰ্ম্ম অবতার।

     মহা নরপতি গেছ পীরিতিম্বির সার 

                                                                 (ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক )

২৯.সুলতান শামস-উদ-দীন ইলিয়াস শাহ (১৩৪২-১৩৫২)

  শ্রী সুখময় মুখোপাধ্যায় আলা-উদ-দীন আলী শাহ ও ইলিয়াস শাহ`র প্রচলিত শিলালিপি ও মুদ্রার সাক্ষে বলেন,"ইলিয়াস শাহের রাজত্বের প্রাচীনতম তারিখ  ৭৪৩ হিজরীর ২রা শ্রাবন। ঐ তারিখে উৎকীর্ণ তার একটি শিলালিপি পাওয়া যায়। ৭৪৩ থেকে ৭৫৮ হিজরী পর্যন্ত ইলিয়াস শাহের মুদ্রা পাওয়া যাচ্ছে। অতএব ৭৪৩ হিজরীর সাবান মাসের আগেই যে আলাউদ্দিন আলী শাহের রাজত্ব শেষ হয়েছিল , সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তার রাজত্ব কবে আরম্ভ হয়েছিল তা ও  অনুমান করা কঠিন নয়। ৭৪২ হিজরীতে সর্বপ্রথম আলাউদ্দিন শাহ এর মুদ্রা পাওয়া যাচ্ছে। ঐ বছরেই তিনি সিংহাসনে আরোহন  করেন। 

৭৩৯ হিজরী তে ফখর-উদ্দিন মুবারক শাহ বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তারপর কদর খান কর্তৃক বিদ্রোহ দমন , কদর খানের হত্যা ,ফখরুদ্দিন কর্তৃক লাখনৌতি অধিকার,সেখানে মুখলিসকে শাসনকর্তা নিযুক্ত করা,আলী শাহ কর্তৃক মুখলিসকে বধ ও লখনৌতি পুনরাধিকার ,মুহম্মদ তোগলোকের কাছে শাসনকর্তা নিয়োগ করতে চিঠি লেখা,মুহম্মদ তোগলোক কর্তৃক শাসনকর্তা নিয়োগ ,সেই শাসনকর্তার মৃত্যু,অতপর মুহম্মদ তোগলোকের কিছুকাল নতুন শাসনকর্তা নিয়োগে অবহেলা এবং তার ফলে আলী শাহ এর সিংহাসনে আরোহন-এই ঘটনাগুলো ঘটেছিলো বলা হয়েছে। 

এতো ঘটনা ঘটতে ৩/৪ বছরের কম সময় লেগেছে বলে মনে হয় না। অতএব আলী শাহ ৭৪২ হিজরীতে সিংহাসনে আরোহন করে বলেছে ধরা হয়। পরবর্তীকালের ইতিহাস গ্রন্থগুলিতে লেখা আছে যে ,আলী শাহ এক বছর কয়েক মাস রাজত্ব করেন। এই কথা সত্য বলে মনে হয় বা.সুতরাং আলী শাহ ৭৪২ হিজরীর গোড়ার দিকে সিংহাসনে আরোহন করেন বলে অনুমান করা যায় 

   শ্রী মুখোপাধ্যায় আরও বলেন ,"ইলিয়াস শাহ ৭৪৭ হি. বা ১৩৪৬ খ্রি  .মধ্যেই সাতগাঁও অঞ্চল জয় করেছিলেন;কারণ ৭৪৭ হিজরীতে সাতগাঁও এর টাকশাল থেকে তার মুদ্রা প্রকাশিত হয়েছিল। 

  মসনদে আরোহন করেই শামস-উদ-দীন ইলিয়াস শাহ রাজ্য বিস্তারে মনোনিবেশ করেন। ১৩৫০ সালে তিনি নেপালে অভিযান চালিয়ে সফল হন। দুর্গম নেপালে অভিযান করা তখনকার দিনে ছিল খুবই দুঃসাধ্য ব্যাপার। কিন্তু ইলিয়াস শাহ এই দুঃসাধ্য কার্য সাধন করেছিলেন।এর থেকেই তার শক্তিমত্তা ও মনের দৃঢ়তার পরিচয় মেলে। তারিখ-ই-ফিরিশতা ও তাবাকত-ই-আকবরীর সাক্ষ্য অনুযায়ী শামস-উদ্দিন-ইলিয়াস শাহ জাজনগর অর্থাৎ উড়িষ্যায় সফল অভিযান চালিয়েছিলেন। তিনি ত্রিহুতও অধিকার করে নিয়েছিলেন। সিরাত-ই-ফিরোজশাহী অনুযায়ী ইলিয়াস শাহ চম্পারণ,গোরক্ষপুর ও কাশি জয় করে এক বিশাল ভূখণ্ড তার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছিলেন। তারপর ৭৫৩ হিজরীতে বা ১৩৫২-৫৩ সালে তিনি সুলতান ফখর উদ্দিন মুবারক শাহ এর পুত্র ইখতিয়ার উদ্দিন গাজী শাহ এর কাছ থেকে জয় করে নেন সোনারগাঁও তথা পূর্ববঙ্গ। এর ফলে ইলিয়াস হলেন সমগ্র বাংলাদেশেরই শাহ বা "শাহ-ই-বাঙ্গালা " 

 ইলিয়াস শাহ এর এসব সাফল্যকালে দিল্লি সালতানাতের  অবস্থা  খুবই নাজুক ছিল। সম্রাজ্যের অরাজকতা নিয়ে সুলতান মুহম্মদ বিন তুগলক খুবই ব্যাতিব্যাস্ত।বাংলার দিকে নজর দেয়ার অবকাশ ছিল না মুহম্মদ বিন তুঘলকের। এমনি অবস্থায় ১৩৫১ সালে তার মৃত্যু হয়। দিল্লির মসনদে আরোহন করেন তার ভাতৃষ্পুত্র  ফিরোজ শাহ তুগলক। দিল্লি সালতানাতে শৃংখলা প্রতিষ্ঠা করেই সুলতান ফিরোজ শাহ তুগলক ইলিয়াস শাহকে দমনের উদ্দেশ্যে যুদ্ধযাত্রা শুরু করেন। এখানে উল্লেখ্য যে,ফিরোজ শাহ যখন বাংলার পথে অগ্রসর হচ্ছিলেন তখন দিল্লি সম্রাজ্যের ভিতরেই চলছিল বাংলার  সুলতান ইলিয়াস শাহ এর আক্রমন। অতএব ধরে নেয়া যায় যে ,সুলতান ফিরোজ শাহ বাধ্য হয়ে বাংলার সুলতানকে স্বীয় সম্রাজ্য থেকে বিতাড়িত করার জন্য এবং সম্ভব হলে বাংলার হৃত রাজ্য পুনর্দখলের জন্য সুলতান ফিরোজ শাহ বাংলার পথে অভিযান পরিচালনা করেন। দুই সুলতানের মধ্যে এই যে সংঘর্ষ,তা ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। 

এই সংঘর্ষের বিবরণ ইতিহাসের তিনটি গ্রন্থে উল্লেখিত হয়ে আছে। ঐ তিনটি ইতিহাস গ্রন্থ হচ্ছে -জিয়াউদ্দিন বারণী রচিত "তারিখ-ই-ফিরোজশাহি " শামস-ই-সিরাজ আফিফ রচিত "তারিখ-ই-ফিরোজশাহী" এবং অজ্ঞাতনামা কোনো ব্যক্তি কর্তৃক স্বয়ং ফিরোজ শাহ এর নির্দেশে রচিত সীরাত-ই-ফিরোজ-শাহী "  তিনটিই ফিরোজ শাহের অনুগত লোকের লেখা। সুতরাং যে ক্ষত্রে জয়,পরাজয়ের প্রশ্ন জড়িত ,সেক্ষত্রে তাদের উক্তি একদেশদর্শিতা-দোষে দুষ্ট হয়ে পড়েছে। 

  ইতিহাস তিনটির মূল বক্তব্য হচ্ছে ,বাংলার সুলতান অপরাধী এবং যুদ্ধক্ষেত্রেও খুব একটা সাহসী নন। দিল্লির সুলতান নেহায়েত মানবতার কারণেই পরাজিত ইলিয়াস শাহ এর সঙ্গে সন্ধি করে দিল্লি ফিরে গেছেন ইত্যাদি। এই দুই সুলতানের যুদ্ধ প্রসঙ্গে শ্রীমুখোপাধ্যায় বিভিন্ন ঘটনার বিশ্লেষণ করে বলেন "আসল কথা ফিরোজ শাহের সঙ্গে সংঘর্ষে ইলিয়াস শাহ পরাজিত হননি। পলায়নও করেননি;তিনি উচ্চাঙ্গের রণকৌশল অনুযায়ীই  কাজ করেছিল।ফিরোজ শাহ কে সৈন্যবাহিনী সমেত নিজের রাজ্যের  অনেক দূরে  প্রবেশ করতে দিয়ে তিনি একডালা দুর্গে আশ্রয় নিয়ে কালক্ষেপন করেছিলেন। তিনি জানতেন যে,যুদ্ধের আগে তিনি একডালা দুর্গ জয় করতে পারবেন না।

 অতঃপর বর্ষা উপস্থিত হইলে ফিরোজ শাহ এর বাহিনী অসহায় হয়ে পরবে। তখন তিনি অতি সহজেই তাদের পরাজিত করতে পারবেন। পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ থেকে বোঝা যায় যে,কোনো পক্ষই এই যুদ্ধে চূড়ান্তভাবে জয়ী হতে পারেন নি। ফিরোজ শাহ কয়েকজন বন্দি ,কিছু  লুটের মাল ও কয়েকটি হাতি ভিন্ন কিছুই এই যুদ্ধ থেকে লাভ করতে পারেন নাই। তার পক্ষেও নিশ্চই কিছু ক্ষতি হয়েছিল ,যার কথা পূর্বোক্ত লেখকরা চেপে গিয়েছেন। কিন্তু ফিরোজ শাহ এই যুদ্ধেই ইলিয়াস শাহ এর বলবীর্যের প্রমান পেয়েছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন যে ইলিয়াস শাহ কে পর্যুদস্ত করা বা একডালা দুর্গ দখল করা দুই-ই তার পক্ষে অসম্ভব। উপরন্তু বর্ষাকাল এলেই তার শোচনীয় পরাজয় ঘটবে।তাই তিনি হাতি জয়ের  দাঁড়াই যুদ্ধ জয় হয়েছে এমন কথা বলে কোনো রকমে নিজের মান বাঁচিয়ে সসৈন্যে বাংলাদেশ থেকে প্রস্থান করলেন। 

পরে প্রচারের  মধ্য দিয়ে তিনি নিজের গ্লানি গোপন করেছিলেন। যাই হোক ,অবশেষে সন্ধি চুক্তির মাধ্যমে এই যুদ্ধের অবসান হয়। সুলতান ফিরোজ বাংলা পুণর্দখল করতে  সত্য ,কিন্তু ইলিয়াস শাহ কর্তৃক অধিকৃত দিল্লি সম্রাজ্যের বিভিন্ন এলাকা পুনর্দখল করে সুলতান ফিরোজ শাহ ইলিয়াস শাহ এর উচ্চাভিলাষ রোধ করতে সমর্থ হন। 

অতঃপর ইলিয়াস শাহ পরবর্তী  সময়ে স্ব-রাজ্যের  সাধন করেন।তার মধ্যে কামরূপের কিছু অংশে বাংলার অধিকার প্রতিষ্ঠা উল্লেখযোগ্য। সুলতান ইলিয়াস শাহ বাংলার মর্যাদা রক্ষার সঙ্গে সঙ্গে দিল্লির সঙ্গেও সম্পর্কের  সাধন করেন।তিনি মালিক তাজউদ্দীন ও অন্যান্য কয়েকজন অমাত্যের মাধ্যমে দিল্লিতে ফিরোজ শাহ তোগলোকের নিকট উপহার প্রেরণ করেন। দিল্লির সুলতান সসম্মানে বাংলার দূতকে গ্রহণ করেন ও বিনিময়ে নিজের দূতের মাধ্যমে মূল্যবান উপহার বাংলায় প্রেরণ করেন। কিন্তু দূত বাংলায় পৌঁছাবার আগেই ৭৫৯ হিজরীতে (১৩৫৭ সালে )সুলতান-শামস-উদ্দিন ইলিয়াস শাহ পরলোক  গমন করেন । 

সুফী-দরবেশগণের প্রতি পরম শ্রদ্ধাশীল এই সুলতান ইলিয়াস শাহর সমসাময়িক তিনজন বিখ্যাত সুফী হচ্ছেন -শেখ আখী সিরাজ উদ্দিন উসমান (রঃ),তার শিষ্য শেখ -আলা-উল হক (রঃ)এবং শেখ রেজা বিয়াবানী (রঃ)কথিত আছে ,ফিরোজ শাহের সঙ্গে যুদ্ধে একডালা দুর্গে  যখন ইলিয়াস শাহ অবরুদ্ধ ,তখন হযরত শেখ রেজা বিয়াবানীর মৃত্যু হয়। সমস্ত বিপদ উপেক্ষা  করে ছদ্মবেশে সুলতান ইলিয়াস শাহ সুফী সাহেবের  জানাজায় শরীক হন। 

একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে ,বাংলার সুলতানদের মধ্যে ইলিয়াস শাহ ছিলেন একজন গৌরবমন্ডিত সুদক্ষ শাসনকর্তা। দীর্ঘ পনেরো বছর  স্বাধীন বাংলার প্রতিষ্ঠা -মূল সুদৃঢ় করে ১৩৫৭ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। শ্রীমুখোপধ্যায়ের কথায় ,"প্রথম জীবনে যিনি একজন নগন্য ব্যক্তি ছিলেন ,তিনিই পরবর্তীকালে এক বিরাট রাজ্যের অধীশ্বর হয়েছিলেন এবং জয়ের পরে জয়ের মুকুট পরে ,প্রবল শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করে নিজের গৌরবের পতাকা উড়িয়েছিলেন। এইরকম অসাধারণ প্রতিভাসম্পন্ন ক্ষণজন্মা  ব্যক্তির  আবির্ভাব শুধু এদেশে নয় অন্য দেশেও খুব কমই হতে দেখা গেছে। তার প্রতিষ্ঠিত ইলিয়াস শাহী বংশের সুলতানগণ বাংলার ইতিহাসকে গৌরবমন্ডিত করে গেছেন। 


If you visit mwlbd then click the download link.


You have to wait 60 seconds.





Post a Comment