লাখনৌতি ও সাতগাঁও :সুলতান ফখর-উদ-দীন মুবারক শাহ  


লাখনৌতি ও সাতগাঁও



  সোনারগাঁও-এর প্রথম যুদ্ধে ফখর-উদ-দীনের পরাজয় এবং সেখানে কদর খানের ক্ষমতা দখলের পর আলী মুবারক নামক কদর খানের এক কর্মচারী লাখনৌতির প্রশাসন দেখাশোনা করতে থাকেন।এর পরবর্তী ঘটনা কদর খানের সঙ্গে ফখর-উদ-দীনের দ্বিতীয় বার যুদ্ধ এবং এই যুদ্ধে কদর খানের পরাজয় ও মৃত্যু।এখানে দুজন ঐতিহাসিকের বক্তব্য তুলে ধরতে চাই.ডক্টর আব্দুল করিম বলেন,সোনারগাঁও-এ  কদর খানের মৃত্যুর খবর পাইয়া লাখনৌতিতে তাহার সৈন্যধাক্ষ (আরিজ )আলী মুবারক সুলতান আলা-উদ-দীন আলী শাহ উপাধি ধারণ কোরিয়া লাখনৌতির সিংহাসনে আরোহন করেন।




 অন্যসুত্রে বলা হইয়াছে যে,আলী মুবারক প্রথমে সুলতান মুহম্মদ বিন তুগলকের নিকট কদর খানের মৃত্যু সংবাদ জানায় এবং নূতন গভর্নর নিযুক্তির প্রার্থনা জানায়। ফলে মালিক ইউসুফ নামক এক ব্যক্তিকে লাখনৌতির গভর্নর নিযুক্ত করে পাঠান হয় কিন্তু পথিমধ্যে মালিক  ইউসুফের মৃত্যু হয়। এই খবর লাখনৌতিতে পৌঁছালে আলী মুবারক নিজে সিংহাসনে আরোহন করেন।কতিথ আছে যে,সোনারগাঁও-এর সুলতান ফখর-উদ-দিন মুবারক শাহ মুখলিস নামক একজন  সেনাপতি কে  লাখনৌতি আক্রমণের জন্য পাঠাইয়াছিলেন কিন্তু আলী মুবারক তাহাকে পরাজিত করেন। অতঃপর সোনারগাঁও এবং লাখনৌতির মধ্যে প্রায় প্রতি বছর যুদ্ধ চলিত। কতিথ আছে যে,ফখর-উদ-দীনের নৌ-বাহিনী থাকায় তিনি বর্ষাকালে লাখনৌতি আক্রমণ করিতেন;অন্যপক্ষে আলী শাহ স্থলযুদ্ধে শক্তিশালী হওয়ায় তিনি শীতকালে লাখনৌতি আক্রমণ করিতেন,কিন্তু কেহ কাহাকেও পরাজিত করিতে পারেন নাই। 

      


লাখনৌতি ও সাতগাঁও



    মতান্তরে সোনারগাঁও-এ কদর খান কে পরাজিত করে ফখর-উদ-দীন মুবারক শাহ লাখনৌতিও অধিকার করেছিলেন, কিন্তু সে অধিকার রক্ষা করতে পারেন নাই। তারিখ-ই-মুবারক শাহীর সাক্ষ্যমতে শ্রীসুখময় মুখোপাধ্যায় বলেন ,ফখর-উদ-দীন লাখনৌতি অধিকার করে সেখানে নিজের তৃত্ব মুখলিস কে শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। 



আলী মুবারক কিন্তু বিশেষ যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে মুখলিসকে বধ করে লাখনৌতি অধিকার করেন;তিনি নিজেকে স্বাধীন সুলতান হিসেবে ঘোষণা করার বিন্দুমাত্র অভিপ্রায় না দেখিয়ে দিল্লীশ্বর মুহম্মদ তোগলোকের কাছে লাখনৌতির একজন শাসনকর্তা নিযুক্ত করার আবেদন জানিয়ে চিঠি পাঠান;মুহম্মদ তোগলোক কর্তৃক নিযুক্ত শাসনকর্তা ইউসুফ বাংলায় এসে পৌঁছাবার আগেই তার মৃত্যু হয় উন্মাদ মুহম্মদ তোগলোক তার জায়গায় আর কাউকে নিযুক্ত করেন নাই। 


তখন আলী মুবারক বাধ্য হয়ে সিংহাসনে বসলেন এবং আলাউদ্দিন আলী শাহ নাম নিলেন।কারণ তার শ্ত্রু ফখরুদ্দীন অনবরত লাখনৌতি অধিকারের চেষ্টা করছেন;লাখনৌতিতে কোনো শাসনকর্তা নাই ,অতএব আলী মুবারকের সে আক্রমণ ঠেকাতে হবে। কিন্তু লোকে রাজা ভিন্ন কারো নির্দেশ সহজে মানবে না,তাই বাধ্য হয়ে তিনি রাজা হলেন। আলী মুবারক যে সত্যিকারের বীর,নিঃস্বার্থপরায়ণ এবং কর্তব্যনিষ্ঠ ছিলেন,তা তারিখ-ই-মুবারক শাহী তে বর্ণিত তার এই ইতিহাস থেকে মনে হয়। 


লাখনৌতি ও সাতগাঁও



           এর মধ্যেই বাংলার রাষ্ট্রনৈতিক বিশৃঙ্খলায় হাজী ইলিয়াস নামে এক তৃতীয় ব্যাক্তির আবির্ভাব ঘটে। তিনি ছিলেন আলা -উদ-দীন আলীর সঙ্গে সম্পর্কিত। কিন্তু সে-সম্পর্কটা যে কি ,তা নিয়ে মতভেদ আছে। "আইন-ই-আকবরীর মতে হাজী ইলিয়াস ছিলেন বাংলার অন্যতম আমির,রিয়াজ-উস-সালাতীন এর  মতে আলাউদ্দিন আলী শাহ এর ধাত্রীমাতার পুত্র এবং বুকাননের মতে আলী শাহের কর্মচারী। 


এসবের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন ইতিহাস "তারিখ-ই-মুবারকশাহী "অনুযায়ী মালিক ইলিয়াস হাজীর বহু সমর্থক ছিল। তিনি লাখনৌতির আমির ও মালিকদের এবং জনসাধারণের সঙ্গে যোগ দিইয়ে আলাউদ্দিনকে বধ করেন এবং সুলতান সামসুদ্দিন নাম নিয়ে সিংহাসনে আরোহন করেন। কিন্তু এই শেষ অবস্থার আগে লাখনৌতির অধিকার নিয়ে হাজী ইলিয়াস ও আলাউদ্দিন আলী শাহ এর মধ্যে সংঘর্ষও হয়েছিল এবং তাতে জয়ী হয়েছিলেন আলাউদ্দিন আলী শাহ।




লাখনৌতি  ও সাতগাঁও



     এভাবে আলাউদ্দিন আলী শাহ এর মৃত্যুর পর বাংলার লাখনৌতি ও সাতগাঁও-এর সুলতান হিসেবে অভিহিত হন সুলতান শামস-উদ -দীন ইলিয়াস শাহ এবং সোনারগাঁও-এর সুলতান হিসেবে নিজ অধিকার রক্ষা করে চলেন সুলতান ফখর-উদ-দীন মুবারক শাহ। 


     সুলতান ফখর-উদ-দীন মুবারক শাহ ফকির-দরবেশগণকে খুবই  শ্রদ্ধা করতেন। তার ১১ বছরের রাজত্বকালে ফকির-দরবেশগণ নানা রকম সুযোগ সুবিধা ভোগ করতেন। সোনারগাঁও রাজ্যে নৌকা যোগে তাদের ভ্রমণে কোনো পয়সা-কড়ি লাগতো না। এমনকি সুলতানের নির্দেশে তাদেরকে প্রয়োজনীয় হাত-খরচও দেয়া হতো। কিন্তু তার জীবনে একটা করুন ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল এই ফকির-প্রীতি থেকেই। 



তিনি শায়দা নামক এক ফকির কে সোদকায়ন-এর শাসন দায়িত্বে নিয়োজিত করেন।কিন্তু সুলতান যখন তার কোনো এক শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে রাজধানী থেকে বাইরে যান ,তখন ফকির শায়দা বিদ্রোহ করে সুলতানের পুত্র কে হত্যা করে বসেন। খবর পেয়ে সুলতান সোদকায়নে ছুটে যান। ফকির তখন সোনারগাঁও-এ  আসেন। 




লাখনৌতি  ও সাতগাঁও




কিন্তু সুলতান পুত্রকে হত্যার সংবাদ তখন রাজ্যময় ছড়িয়ে গেছে। সোনারগাঁও-এর লোকজন ফকির শায়দাকে ধরে ফেলে হত্যা করে। সঙ্গে নিহত হন আরো কয়েকজন ফকির। তবে ফকির শায়দা সোনারগাঁও শহরে পালিয়ে এসেছিলেন কিনা ,তাতেই ঐতিহাসিকদের মতান্তর আছে। আমাদের মনে হয়,ফকির শায়দা সোনারগাঁও শহরে পালিয়ে আসেননি ,পালিয়েছিলেন হয়তো সোনারগাঁও রাজ্যেরই কোনো এক স্থানে এবং সে স্থানেই লোকজন তাকে ধরে ফেলে হত্যা করে। স্বাধীন সোনারগাঁও-এর সুলতান ফখর-উদ-দীন মুবারক শাহের সময়ে চট্টগ্রামে সর্বপ্রথম মুসলিম অধিকারে আসে।



 সতেরো শতকের কবি মোহাম্মদ খানের বক্তব্য অনুসারে ,কদল খান গাজী পীর "অসংখ্য রিপুদল"বিনাশ করে চট্টগ্রামে এক অল্লাহর মহিমা প্রকাশ করেন,কদল খান গাজী পীরের সঙ্গে ছিলেন বদর আলম প্রমুখ "একাদশ মিত্র " বাংলার নান অঞ্চলে ইসলাম প্রচারের কাহিনী পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে,হয় প্রথমে সুফী সাধকরা ইসলাম প্রচারের কাজে বিধর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হলে মুসলমান শাসকেরা তাদের সাহায্যে এগিয়ে যেতেন,অথবা মুসলমান শাসকদের সঙ্গে সীমান্তবর্তী বিধর্মী রাজাদের সংঘর্ষ বাধলে সুফী সাধকরা সেসব যুদ্ধে সামিল হতেন।হুগলী জেলার ত্রিবেণী এলাকায়,সিলেটে এবং চট্টগ্রামে মুসলিম বিজয়ের ঘটনাবলীতে উপরোক্ত বক্তব্যের প্রমান পাওয়া যায়। প্রকিতপক্ষে ,চতুর্দশ শতক বাংলাদেশে ইসলাম ধর্ম প্রচার এবং মুসলমান শাসন বিস্তারের ইতিহাসে এক স্বর্ণযুগ। 




লাখনৌতি  ও সাতগাঁও



যদিও ত্রয়োদশ শতকের গোঁড়ার দিকে বখতিয়ার খলজি লাখনৌতি কে কেন্দ্র করিয়া  বাংলাদেশে প্রথম মুসলমান রাজ্যের গোড়াপত্তন করেন ,দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকারের সহিত বাংলার মুসলমান শাসকদের সংঘর্ষ এবং দিল্লির সরকারের দুর্বলতার ফলে একশত বৎসর বাংলাদেশেও মুসলমানেরা বিশেষ রাজ্য বিস্তার করতে পারে নাই। কিন্তু চতুর্দশ শতক হইতে ,অর্থাৎ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে মুসলমানদের আগমন বাড়িতে থাকে এবং সুফী সাধকরা অধিক সংখ্যায় আগমন করিতে থাকেন। 



লাখনৌতি  ও সাতগাঁও


      অনেকে কদল খান গাজীকে সুলতান ফখর-উদ-দীন মুবারক শাহের সেনাপতি মনে করে থাকেন। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক আব্দুল করিম খান তা মনে করেন না। তার কথায়,এখানে স্মরণ রাখা দরকার যে ,কোন সেনাপতির পক্ষে পরবর্তী জীবনে আধ্যাতিক উৎকর্ষ সাধন অসম্ভব নয়,যেমন ত্রিবেণীর জাফর খান গাজী,বাগেরহাটের খান জাহান আলী এবং রংপুর জিলার কাঁটাদুয়ারের শাহ ইসমাইল গাজী সম্পর্কে অনেকে মনে করিয়া  থাকেন। চট্টগ্রামে কদল খান ও পীর বদর আলমের  ভবন দৃষ্ট হয়। 



চট্টগ্রামের একটি এলাকা কদল খান গাজীর নামানুসারে কাতালগঞ্জ নামে পরিচিত। চট্টগ্রামের লোকেরা কদল খান গাজীকে এখনো সুফিরূপে ভক্তি সহকারে স্মরণ করিয়া থাকেন। ডক্টর আব্দুল করিমের মতে ,সুফী কদল খান গাজী তার সঙ্গী ও শিষ্যদের নিয়ে চট্টগ্রামে ইসলাম প্রচারে রত হন এবং তাতে করে সংঘর্ষ আরম্ভ হলে সুলতান ফখর-উদ-দিন তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। আর এভাবেই চট্টগ্রামে প্রতিষ্টিত হয় মুসলমান অধিকার। এই বিজয়ের সময়কাল হচ্ছে ১৩৩৮ সাল থেকে ১৩৪৬ সাল। 

  

  সুলতান ফখর-উদ-দীনের শাসনামলের আরো একটি স্মরণীয় ঘটনা হচ্ছে ইবনে বতুতার বাংলা সফর। মরক্কোর অধিবাসী বিশ্ব পর্যটক ইবনে বতুতা সম্ভবত ১৩৪৬  সালে বাংলার চট্টগ্রাম বন্দরে পদার্পণ করেন। চট্টগ্রাম থেকে তিনি হযরত শাহ্জালাল রহমতুল্লাহি আলাইহের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে নদীপথে সিলেট যান। সেখানে কিছুদিন অবস্থানের পর নদীপথেই আসেন সোনারগাঁও-এ। সোনারগাঁও-এ অবস্থান শেষে জাহাজ যোগে তিনি চলে যান জাভায়। ইবনে বতুতা তার সফরনামায় বাংলার অবস্থা বর্ণনা করে গেছেন।  অপ্রাসঙ্গিক হলেও এখানে তার বর্ণনার কিছু বিবরণী তুলে ধরছি।



লাখনৌতি  ও সাতগাঁও




   ইবনে বতুতার সামনেই একজন সুন্দরী দাসী কেনা হয়েছিলো ৭ টাকায়। মোহাম্মদ আল মাশহাদী নামক মরোক্কোর এক ভদ্রলোক কিছুদিন এদেশে বসবাস করেছিলেন। তিনি ইবনে বতুতাকে বলেন যে,তার তিনজনের একটি পরিবারের জন্য বছরে খরচ হয় মাত্র ৭ টাকা। 




ইবনে বতুতা আরো বলেন যে ,খাদ্যশস্যের প্রাচুর্যের জন্য বিদেশী লোকেরা একদিকে যেমন বাংলাকে পছন্দ করতেন ,অন্যদিকে এদেশের জলবায়ু মোটেও পছন্দ করতেন না। তাই তারা বাংলাকে বলতো "দোজখ-পুর-আজনিমত "বা ধন -সম্পদে পরিপূর্ণ দোজখ। 


     ইবনে বতুতা বাংলায় সুফী-সাধক ও ফকির-দরবেশের যথেষ্ট প্রতিপত্তির কথা উল্লেখ করেছেন। সুলতান ফখর-উদ-দিনে মুবারক শাহ ফকির-দরবেশের প্রতি ছিলেন বেশ শ্রদ্ধাশীল। নৌকায় যাতায়াত করতে তাদের কোনো পয়সা-কড়ি লাগতো না। যাদের আহার বাসস্থানের সংস্থান থাকতো না ,তাদের জন্য সে বাবস্থা করা হতো। 





তারা কোনো শহরে প্রবেশ করলে প্রত্যেককে দেয়া হতো আধা দিনার। ইবনে বতুতা চট্টগ্রাম বন্দরে অনেক জাহাজ দেখেছিলেন। তাছাড়া সিলেট  থেকে নদীপথে সোনারগাঁও-এ আসার সময় ইবনে বতুতা  তীরের অপূর্ব শোভা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন।নদী তীরে তিনি দেখেছেন দিগন্ত বিস্তারি শস্যক্ষেত্র ,সবুজ -শোভিত গ্রাম ;দেখেছেন বাংলার জমজমাট হাট-বাজার। 


You have to wait 60 seconds.



Post a Comment