মুর্শিদাবাদ নাজিমী আমল : নবাব-নাজিম মনসুর আলী খান বা ফেরিদুনজা (১৮৩৮-৫ নভেম্বর, ১৮৮৪ সাল) 


মুর্শিদাবাদ নাজিমী আমল : নবাব-নাজিম মনসুর আলী খান |  পর্ব ০৩





মীর জাফর ও তদবংশীয়দের কথায় ফিরে আসা যাক। ''সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের নেতা হইয়া, ইংরেজদিগের সহিত যোগদান পূর্বক সিরাজের সর্বনাশের পর মীর জাফর মুর্শিদাবাদের মসনদে উপবিষ্ঠ হন। মসনদে বসিয়া তিনি ইংরেদিগের দুর্ব্যবহারে অত্যন্ত ব্যাথিত হইয়া উঠেন এবং তাহাদিগের হস্ত হইতে আপনাকে মুক্ত করিয়া স্বাধীন হওয়ার ইচ্ছা করিয়াছিলেন। 

তাহার জ্যৈষ্ঠপুত্র মীরনের সেই ইচ্ছা অধিকতর বলবতী ছিল। কিন্তু ইংরেজেরা মীর জাফরকে বলপূর্বক পদচ্যুত করিয়া তাহার যেতাম মীর কাশেমকে সিংহাসন প্রদান করেন। আবার মীর কাশিমের সহিত মনোবিবাদ উপস্থিত হইলে পুনর্বার মীর জাফরকে নবাব মনোনীত করিতে বাধ্য হন।''  তারপর নামেমাত্র এই নবাবার মৃত্যু হয় ১৭৬৫ সালের জানুয়ারিতে, ৭৪ বছর বয়সে। 




অতঃপর বাংলায় আরম্ভ হয় দ্বৈত-শাসন। মীর জাফর বংশীয়রা হন নাজিম; কিন্তু নেহায়েত সম্মানার্থে 'নবাব' শব্দটাও রেখে দেওয়া হয়। পুরো উপাধিটা হয় নবাব-নাজিম। ''মীর জাফরের মৃত্যুর পর নজম উদ্দৌলা নিজামতি প্রাপ্ত হন। মীর জাফর জীবিত থাকতেই তাহার জ্যৈষ্ঠপুত্র মীরনের মৃত্যু হইয়াছিল, কলিকাতা কাউন্সিলের সভ্যেরা মীরণের পুত্রগণের আবেদন না শুনিয়া, নজম উদ্দৌলাকেই মসনদ প্রদান করেন। 

নজম উদ্দৌলা মীর জাফরের জীবিত পুত্রগণের মধ্যে জ্যেষ্ঠ ছিলেন এবং মুসলমান ব্যাবহারশাস্ত্রানুসারে তিনিই মীর জাফরের প্রকৃত উত্তরাধিকারী। কারণ, মুসলমান নিয়মানুসারে পিতামহ বর্তমানে পিতার মৃত্যু হইলে এবং পিতৃব্য জীবিত থাকিলে পৌত্ররা পিতামহের উত্তরাধিকারী হইতে পারেন না। 



Bohubrihi online courses





নবাব-নাজিম মনসুর আলী খান বা ফেরিদুনজা 


এই মনসুর আলী খানই বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার সর্বশেষ নবাব-নাজিম। তার সময়ে নির্মিত হয় মুর্শিদাবাদের বর্তমান ইমামবারা। এই ইমামবারা হুগলির বিখ্যাত ইমামবারার চাইতেও বড় আকারের। পুরনো ইমামবারা নির্মাণ করেছিলেন নবাব সিরাজুদ্দৌলা। ১৮৪৭ সালে নতুন ইমামবারা নির্মিত হয়। মনসুর আলী খাঁর সময় থেকেই মুর্শিদাবাদের সমস্ত গৌরবের অবসান হয়।

 এ সময়ে নিয়ামতের জন্য নির্দিষ্ট বৃত্তি আরও কমিয়ে দেওয়ার কথা ওঠে। নবাব-নাজিম মোবারক-উদ-দৌলার সময় থেকে এই বৃত্তির পরিমান ছিল বার্ষিক ১৬ লক্ষ টাকা। তার মধ্যে নবাবের নিজ ব্যয়ের জন্য নির্দিষ্ট ছিল ৭ লক্ষ টাকা। মনসুর আলী খানের সময়ে সরকার থেকে প্রকাশ করা হয় যে, গভর্নর-জেনারেল ইচ্ছা করেই এই বৃত্তি কমিয়ে দিতে পারবেন। অবিশ্যি মনুর আলী খানের জীবদ্দশায় তা আর কমানো হয় নাই। 


কিন্তু সম্মানের লাঘব ঘটে অন্যন্য ব্যাপারে। এ সময়েই নবাব-নাজিমের সম্মানে ১৯ তোপ দাগানোর স্থলে ১৩ তোপ দাগানোর হুকুম জারি হয়। আগে নবাবের অনুমতি ব্যতীত মুর্শিদাবাদ কেল্লায় কেও প্রবেশ করতে পারত না। এবারে ইংরেজ সরকার সে অনুমতির নিয়ম রদ করে। তাছাড়া মণি বেগমের সঞ্চিত তহবিলে যে সমস্ত ধন-সম্পদ ছিল, নবাব-নাজিমকে তার অধিকার থেকেও বঞ্চিত করা হয়। 



এর মধ্যে অবিশ্যি দিল্লীর 'বাদশা'র সম্মানও ধুলোয় লুন্ঠিত হয়েছে। মারাঠা শক্তিকে ক্ষমতাচ্যুত করে ১৮০৩ সালে ইংরেজ সেনাপতি লর্ড লেইক দিল্লী অধিকার করলে 'সম্রাট' দ্বিতীয় শাহ আলম ইংরেজের আশ্রিত এক বৃত্তিভোগীতে পরিণত হন। দ্বিতীয় শাহ আলমের পুত্র 'সম্রাট' দ্বিতীয় আকবরও (১৮০৮-১৮৩৬ সাল) ইংরেজাশ্রিত বৃত্তিভোগী 'বাদশা'র জীবন অতিবাহিত করেন।

amazon



 এই অবস্থা চলে শেষ মুগল 'বাদশা' বাহাদুর শাহ জাফরের কালেও। তারপর ১৮৫৭ সালের সেই ইতিহাসখ্যাত 'সিপাহী যুদ্ধে' জড়িত হয়ে পড়েন বাহাদুর শাহ জাফর। ইংরেজের বিরুদ্ধে জোয়ান-জনতার সেই অভ্যুত্থান ব্যার্থতায় পর্যবসতি হওয়ার পর ১৮৫৮ সালে নির্বাসন দণ্ডে দণ্ডিত হন অশীতিপর বৃদ্ধ বাহাদুর শাহ জাফর। 




এমনি অবস্থার প্রেক্ষাপটে মুর্শিদাবাদের নামেমাত্র নবাব নবাব-নাজিমের সন্মান লাঘবের উপরোক্ত চিত্র বিস্ময়ের উদ্রেক করবে কেন! তাছাড়া, স্বাধীনতা হারানোর জ্বালা এদেশের স্বাধারণ মানুষকে যতটা ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল, মুর্শিদাবাদের তদানীন্তন 'নবাব'গণকে তা হয়তো তেমন কোনো কষ্ট দেয় নি। তা না হলে ১৮৫৭ সালের ফেরুয়ারি মাসের মনসুর আলী খান ওরফে ফেরিদুনজা যখন নবাব-নাজিম এবং যখন মীরাট ও দিল্লীর সিপাহীদের অভ্যুত্থানের তিন মাস পূর্বে কলকাতার নিকটবর্তী ব্যারাকপুরের এবং তারপর বহরমপুর শহরে সমবেত হয়ে কোন নেতৃত্বের সন্ধান না পেয়ে স্বাধীন বাংলার নবাবের বংশধর বহরমপুরবাসী মনসুর আলী খানের নিকটেই নির্দেশ প্রার্থনা করেছিল, তখন কোন উত্তর না পাওয়ায় টসদেরকে হতাশ হয়ে ফিরে আসতে হয়েছিল কেন? ইংরেজ ঐতিহাসিক কের কথা, ''হাজার হাজার মানুষ শহরে সমবেত হয়েছিল। 


তাহার যে ব্যাক্তিটির নির্দেশ পাইলেই বিদ্রোহে ঝাঁপিয়ে পরিত সেই ব্যাক্তিটি নিজে দুর্বল হইলেও একটি বিখ্যাত নামের মর্যাদায় যথেষ্ট শক্তিশালী ছিলেন। ইহা সহজেই বুঝিতে পারা যায় যে, যদি বহরপুরের সিপাহীরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করিত এবং মুর্শিদাবাদের জনসাধারণ নবাবকে সম্মুখে রাখিয়া সিপাহীদের সহিত মিলিত হইত, তাহা হইলে দেখিতে না দেখিতে সমগ্র বাংলায় আগুন জ্বলিয়া উঠিত। 

বাঁকুড়া জেলার গেজেটিয়ার থেকেও জানা যায় যে, বহরপুরের বিদ্রোহের খবর শোনামাত্র কৃষ্ণগর, যশোর ও সমগ্র বিভাগে একটা ভয়ংকর অবস্থা দেখা দিয়েছিল। শাসকগণ এই ভেবে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে উঠেছিল যে, যে কোন সময় বাঁকুড়া জেলার সাঁওতাল ও চোয়াড়দের মধ্যে বিদ্রোহ দেখা দিতে পারে।  সেই সিপাহী অভ্যুত্থানের সময়ে ''বঙ্গীয় সরকারের অধীনে এমন একটিও জেলা ছিল না, যাহা প্রত্যক্ষ বিপদের মধ্যে দিয়া অতিক্রম করে নাই অথবা যেখানে ভয়ঙ্গকর বিপদের আশংকা চুল না। 



নিশ্চয়ই ইংরেজ সরকারের ভয়েই মুর্শিদাবাদের নবাব-নাজিম মনসুর আলী খান সমবেত ইংরেজ বিদ্রোহীদের সামনে দাঁড়িয়ে নির্দেশ দান তো দূরের কথা, তাদেরকে ফিরে যেতেও বলেন নাই। ঐতিহাসিক কে একটা ভুল শব্দ ব্যবহার করেছেন। নবাব-নাজিম মনসুর আলী খান বাংলার স্বাধীন নবাবের বংশদর ছিলেন না, ছিলেন স্বাধীনতা বিকিয়ে দেওয়া 'নবাবের' বংশধর। তাই হয়তো তার ছিল এতো ভয়! মুর্শিদাবাদের নবাব-নাজিমদের প্রতি, বিশেষ করে, মনসুর আলী খানের প্রতি ইংরেজ সরকার তো আর সন্মান বলতে তেমন কিছুই দেখায় নাই! 



Aliexpress Click & Buy




এই প্রসঙ্গে মনে পরে দিল্লীর 'বাদশা' অশীতিপর বৃদ্ধ বাহাদুর শাহ জাফরের কথা। উপরোক্ত ঘটনার তিন মাস পরে মীরাটের অভ্যুত্থানকারীরা তাদেরকে নেতৃত্ব দান করার জন্য অতি ভোরে বাদশাহী ফটকের সামনে জমায়েত হয়ে বাদশার উত্তর আশা করছিল, তখন শক্তিধর ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে এমন অভ্যুত্থানের ভয়ঙ্কর পরিণতির কথা জানা থাকা সত্ত্বেও ইংরেজের সামান্য বৃত্তিভোগী সেই বাহাদুর শাহ জাফর সিপাহীদের প্রত্যাশার অনুকূলে জবাব দিয়েছিলেন। 

বাহাদুর শাহ জাফর ছিলেন বাদশা বাবর-হুমায়ুন-আকবর-জাহাগীর-শাহজাহান-আলমগীরের খান্দানের লোক। তার নেতৃত্বে অভ্যুত্থানকারীরা পরাজিত হয়েছিল, বাহাদুর শাহ জাফরও নির্বাসিত হয়েছিলেন রেঙ্গুনের অতি নিকৃষ্ট একটি স্থানে। তবু জন্মভূমির স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের আহবানে তিনি সাড়া দিয়েছিলেন!

আরো পড়ুন :






বিশ্ব সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে জানতে ঘুরে আসুন বাংলার পাঁচ মুক্ত সাহিত্যকোষ থেকে






Post a Comment