ইলিয়াস শাহী রাজবংশ : সুলতান শামস - উদ -দীন ইউসুফ শাহ (১৪৭৪-১৪৮১)




ইলিয়াস শাহী রাজবংশ : সুলতান শামস - উদ -দীন ইউসুফ শাহ










 

সুলতান রুকন-উদ-দীন বারবক শাহ এর পুত্র সুলতান শামস উদ-দীন ইউসুফ শাহ কৃতিত্বের সঙ্গে সাত বছরের মত বাংলা শাসন করেন। বুকাননের কথায় 'এই সুশিক্ষিত রাজপুত্র '  ন্যায়বিচারক,ধর্মনিষ্ঠ ও সুশাসক। কিন্তু কোন গ্রন্থেই তার সম্পর্কে বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায় না। কেবলমাত্র তারিখ-ই-ফিরিশতায় কয়েকটি কথা পাওয়া যায়। ফিরিশতা লিখেছেন,  তিনি লিখেছেন বিদ্বান ,ধার্মিক এবং কৌশলী নরপতি। তিনি ভালো কাজ  করতে আদেশ দিতেন এবং মন্দ কাজ করতে নিষেধ করতেন।





 তার আমলে কেউ প্রকাশ্যে মদ্যপান করতে বা তার আদেশ অমান্য করতে সাহস পেত না। মাঝে মাঝে তিনি প্রধান প্রধান আলিমদের তার সভায় ডেকে বলতেন ,আমরা ধর্ম সংক্রান্ত বিষয়ের নিষ্পত্তি করতে গিয়ে কারও পক্ষ অবলম্বন করবেন না ইত্যাদি। তিনি নিজে বহু শাস্ত্রের সুপণ্ডিত ছিলেন ,তাই যে সমস্ত মামলায় কাজীরা ব্যর্থ হতেন , তাদের অধিকাংশেরই তিনি নিজে নিষ্পত্তি করতেন।





সম্প্রতি কোন কোন ঐতিহাসিক তাকে পান্ডুয়ায় অবস্থিত একটি মন্দির ভেঙ্গে মসজিদ নির্মাণের অপরাধে সাম্প্রদায়িক বলে আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু ডক্টর  এই মতের বিরোধিতা করে বলেন ,''মুসলমানেরা এই দেশে আসার পরে ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দিরের পাথর ইত্যাদির সাহায্যে মসজিদ তৈয়ার করেন এই কথা সত্য ,বাংলাদেশেও এইরূপ উদাহরণ যথেষ্ট পাওয়া যায়,কিন্তু অটুট এবং ব্যবহার্য মন্দির ভাঙ্গার  নজীর বিরল। 



ইউসুফ শাহ  কর্তৃক নির্মিত মসজিদে মন্দিরের ভাঙ্গা টুকরা পাইলেই  তাহাকে  পরধর্মী বিদ্বেষী বলার কোন হেতু  নেই। ইউসুফ জ্ঞানী এবং নিষ্ঠাবান মুসলমান ছিলেন  সত্য কিন্তু নিষ্ঠাবান মুসলমান হইলেই পরধর্ম বিদ্বেষী হইবেন  এমন  কথা নয়। নিছক ভিন্ন ধর্ম অবলম্বন করার কারণে ইউসুফ শাহ কাহারও উপর  অত্যাচার করেন-এমন কোন  প্রমান পাওয়া যায় না। তার রাজত্বকালে যে সব মসজিদ নির্মিত হয় ,তার মধ্যে মালদহের সাকামোহন মসজিদ ,গৌড়ের 'কদমরসুল 'মসজিদ ,দরাসবাড়ি  জামে মসজিদ ও তাঁতীপাড়া মসজিদ উল্লেখযোগ্য। 



ছোটো পাণ্ডুয়া থেকে আবিষ্কৃত তার শিলালিপিটি থেকে ধারণ করে চলে,তার আমলে পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম অধিকার আরও প্রসারিত হয়েছিল। অন্যান্য শিলালিপি থেকেও বোঝা যায় ,উত্তরবঙ্গ পূর্ববঙ্গের বৃহৎ অঞ্চল তার রাজ্যভুক্ত ছিল। 



আরো পড়ুন :




সুলতান জালাল-উদ-দীন ফতেহ শাহ (১৪৮১-১৪৮৭ সাল )


সুলতান ইউসুফ শাহের মৃত্যুর পর তার পুত্র সিকান্দার শাহ মসনদে আরোহণ করলেও প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন এবং ফতেহ নামক মাহমুদ শাহ খান্দানেরই এক শাহযাদা জালাল-উদ-দীন আবুল মুজাফ্ফর ফতেহ শাহ উপাধি গ্রহণ করে বাংলার মসনদে আসীন হন।ইতিহাসে তিনিই জালাল-উদ-দীন ফতেহ শাহ বলে পরিচিত। ফতেহ শাহ ছিলেন সুলতান নাসির -উদ-দীন মাহমুদ শাহ এর কনিষ্ঠ পুত্র,সুলতান রুকন-উদ-দীন বারবক শাহ এর ছোট ভাই এবং সুলতান ইউসুফ শাহ এর চাচা। 





প্রচলিত রীতি অনুযায়ী সুলতান মাহমুদ শাহ এর মৃত্যুর পর তার  জ্যেষ্ঠ পুত্র বারবক শাহ বাংলার মসনদ লাভ করেন এবং বারবক শাহ এর মৃত্যুর পর সেই মসনদের অধিকারী হন বারবক শাহ এর পুত্র ইউসুফ শাহ। ফলে সুলতান মাহমুদ শাহ এর কনিষ্ঠ পুত্র ফতেহ শাহ মসনদের অধিকার থেকে স্বাভাবিক ভাবেই বার বার বাদ পড়তে থাকেন। ওদিকে দুৰ্ভাগ্যজনক হলেও বাংলার রাজধানীতে দলাদলির অস্তিত্ব ছিলই এবং সেই সুবাদে ,এটা সহজেই ধরে নেয়া যায় ,ফতেহ শাহ একটি দলের পক্ষ থেকে ছিলেন মসনদের দাবিদার। এখানে এটাও স্মরণ রাখতে হবে যে ,সুলতান বার্বক শাহ প্রায় আট হাজার আবিসিনিয়কে (হাবশী )নিজ সেনা দলে এবং প্রশাসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। 




এই হাবশীরা স্বভাবতই অনুগত ছিল সুলতান বারবক শাহ এবং তার পুত্র ও পৌত্রদের প্রতি। আর ধরে নেওয়া যায় ,এই প্রভাবশালী হাবশীদের সমর্থনেই সুলতান মাহমুদ শাহ এর পর তার পুত্র ইউসুফ শাহ মসনদে আরোহণ করে রাজ্য শাসন করতে পেরেছিলেন। কিন্তু ইউসুফ শাহ এর মৃত্যুর পর মসনদ যখন তার পুত্র সিকান্দার শাহ এর অধিকারে চলে গেল,তখনই ফতেহ শাহ এর দল মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। 




তাই তারা শেষ সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইলো না। পরিণামে ,তরুণ সিকান্দার শাহ কে গদীতে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে বসবার আগেই সরিয়ে দেয়া হলো। সুলতান হলেন ফতেহ শাহ। উপরোক্তভাবেই ত্বরিতে তরুণ সিকান্দার শাহ এর গদিচ্যুতি এবং ফতেহ শাহের মসনদ প্রাপ্তির সঙ্গত ব্যাখ্যা দিয়েছেন ঐতিহাসিক ডক্টর আব্দুল করিম। 






বিভিন্ন ঐতিহাসিকের ভাষ্য অনুযায়ী ,সুলতান ফতেহ শাহ ছিলেন বিজ্ঞ ও বুদ্ধিমান এক সুশাসক। রাজ্য শাসনে তিনি উদার নীতি অনুসরণ করতেন। রাজনীতি ,সমরনীতি ছাড়াও তিনি ছিলেন ধর্ম ও ভেষজ শাস্ত্রে সুপন্ডিত। তবুও মাত্র সাত বছরের মতো রাজ্য শাসনের পর সুলতান জালাল-উদ-দীন  ফতেহ শাহ তার প্রাসাদ রক্ষীদের হাতে নিহত হন। সম্ভবত বারবক শাহ এর আশ্রয়পুষ্ট হাবশীদের চক্রান্তেই নিহত হন সুলতান ফতেহ শাহ। 




রাজনৈতিক দলাদলির ফলে শুধু যে সুলতান ফতেহ শাহ নিহত হন এবং তার মাধ্যমে সম্পন্ন হয় পরবর্তী ইলিয়াস শাহী খান্দানের পতন তাই নয়,পরবর্তী সাত বছর ধরে বাংলায় চলে এলো এক অরাজক শাসন। সে শাসন হাবশীদের শাসন।  ১৪৮৭ সাল থেকে ১৪৯৩ সাল পর্যন্ত ৪ জন হাবশী সুলতান বাংলা শাসন করেন। 


 


এই পরবর্তী ইলিয়াস শাহী বা মাহমুদ শাহী বংশের সুলতানদের সম্বন্ধে বলতে গিয়ে শ্রী মুখোপাধ্যায় বলেন, "বাংলাদেশের ইতিহাসে মাহমুদ শাহী বংশের নাম উজ্জ্বল অক্ষরেই লেখা থাকবে।   এই বংশের রাজারা ইলিয়াস শাহী বংশোদ্ভব কিনা জানি না, তবে পূর্ববর্তী ইলিয়াস শাহী সুলতানদের সঙ্গে এদের সব বিষয়ে স্বাতন্ত্র্য দেখা যায়।আগেকার ইলিয়াস শাহী সুলতানরা বাংলাদেশকে মনেপ্রাণে স্বদেশ বলে গ্রহণ করেছিলেন কিনা সন্দেহ।


 

 কিন্তু এই বংশের রাজারা বাঙালি বলেই গণ্য হবেন। কারণ যে সময় রাজা  গণেশ ও তার বংশধররা ইলিয়াস শাহী বংশকে ক্ষমতাচ্যুত করে বাংলাদেশ শাসন করেছিলেন ,সে সময় এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহ বাংলার জনসাধারণের মাঝেই আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং একটি বিবরণ মতে বাংলার নিভৃত পল্লীতে কৃষিকার্য করে জীবিকা নির্বাহ করেছিলেন।


 


 সিংহাসন অধিকার করে এই বংশের রাজারা শাসনকার্যে সহযোগিতা করার জন্য এই দেশের লোকদের আহবান করলেন -সম্প্রদায় নির্বিশেষে। এই বংশেরই একজন রাজা বিদ্যা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষণের আদর্শ স্থাপন করলেন,বিধর্মী পন্ডিতেরাও তার আনুকূল্য থেকে বঞ্চিত হলো না। এই বংশের চার জন রাজাই (সিকান্দার শাহকে হিসাবের মধ্যে ধরছি না)-নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহ ,রুকন-উদ-দীন বারবক  শাহ ,শামসুদ্দীন ইউসুফ শাহ ও জালালুদ্দিন ফতেহ শাহ অত্যান্ত সুযোগ্য রাজা ছিলেন।


 


 শেষ দু'জন রাজা সময় সময় হিন্দুদের উপর অত্যাচার করেছিলেন (এ ব্যাপারে সকল ঐতিহাসিক একমত নন-লেখক ) আমার বিশ্বাস ,যদি কোনোদিন এই রাজবংশের বিস্তৃত ইতিহাস পাওয়া যায়,তাহলে অনেক গৌরবময় মনোহর ঘটনা বিস্তৃতির অন্তরাল থেকে আত্মপ্রকাশ করবে। 




ইলিয়াস শাহী (পূর্ববর্তী ও পরবর্তী )বংশীয় সুলতানদের সম্বন্ধে ডক্টর আব্দুল করিম বলেন,''ইলিয়াস শাহী সুলতানেরা রাজা গণেশের কারসাজির ফলে সিংহাসনচ্যুত গণেশের বংশের পতনের পরে ইলিয়াস শাহের একজন বংশধর আবার সিংহাসন লাভ করেন। ইহাতেই বাংলাদেশে ইলিয়াস শাহী সুলতানদের জনপ্রিয়তার প্রমান পাওয়া জন্য।



পরবর্তী ইলিয়াস শাহী সুলতানেরাও অত্যান্ত দক্ষতার পরিচয় দেন এবং পূর্ববর্তীদের মত উদারতার ,দক্ষ শাসনের ,সাহিত্য ও সংস্কৃতি প্রীতির এবং স্থাপত্য শিল্পের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করিয়াছেন। বাংলার সামাজিক ,সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসে ইলিয়াস শাহী সুলতানদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকিবে।   



 












Post a Comment