বাংলা সালতানাত: ব্রাক্ষণ্য পুনরুত্থান প্ৰয়াসকাল  





বাংলা সালতানাত: ব্রাক্ষণ্য পুনরুত্থান প্ৰয়াসকাল










''বাংলা দেশের 'মধ্যযুগের' ইতিহাসে যাদের নাম ভাস্বর অক্ষরে লেখা রয়েছে, রাজা গণেশ তাদের মধ্যে অন্যতম। একক কৃতিত্বের দিক দিয়ে গণেশের সঙ্গে খুব কম লোকেরই তুলনা চলতে পারে। ত্রয়োদশ শতাদ্বী থেকে অষ্টাদশ পর্যন্ত বাংলা ছিল মুসলমানদের অধিকারে। এর মধ্যে কোন কোন সময় অঞ্চল বিশেষে হিন্দুদের প্রাধান্য স্থাপিত হয়েছে বটে, কিন্তু সমগ্র বাংলার সিংহাসন অধিকার এই একটিমাত্র হিন্দুর পক্ষে সম্ভব হয়েছিল। পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে গণেশ বিদ্যুৎস্ফূলিঙ্গের মত আবির্ভুত হয়ে অসাধ্য সাধন করেছিলেন, প্রবল বিরুদ্ধশক্তির বাধাকে জয় করে বাংলায় হিন্দু রাজত্ব গড়ে তুলেছিলেন। গণেশের কীর্তির অসামান্যতা সম্বন্ধে ঐতিহাসিকদের মধ্যে দ্বিমত নেই।'' 





মুসলিম অধিকৃত বাংলার তদানীন্তন ভেতরের ও বাইরের হিন্দু- মনোভাবের প্রেক্ষিতে এবং সুলতানি দরবারের চারিত্রিক পরিচয়ের বিবেচনায় আমাদের সিদ্ধান্তটা একটু অন্য রকমের। হিন্দু শক্তি পুনরুত্থানের ক্ষেত্র বাংলার সুলতান দরবারে অনেক দিন ধরেই প্রস্তুত হচ্ছিল। তারই সব লক্ষণ ধরা পড়েছিল হযরত মুজাফ্ফর শামস বলখীর দৃষ্টিতে। তিনি সব উপদেশ দিয়েছিলেন। সুলতান গিয়াস-উদ-দীন আজম শহর চৈতন্যেদয়ও হয়তো ঘটেছিলো। কিন্তু ততো দিন বহু বিলম্ব হয়ে গেছে। 





তাই সুলতানের জ্ঞানোন্মেষের সঙ্গে সঙ্গেই আঘাত হানলেন ব্রাক্ষন্য শক্তির পুরোধা রাজা গণেশ। নিহত হলেন সুলতান গিয়াস-উদ-দীন আজম শাহ। সুলতান হলেন নিহত সুলতানের পুত্র সাইফ-উদ-দীন হামজা শাহ। দু'বছর যেতে না যেতেই আবার হানা হলো আঘাত। এবার তরুণ সুলতানের হত্যাকারী সুলতানের ত্রীতদাস শিহাব-উদ-দীন। হত্যা করলেন রাজা গণেশ। আপাত দৃষ্টিতে শেষ হয়ে গেল ইলিয়াস বংশের রাজত্ব। 



''সৈফুদ্দিন হামজা শাহের মৃত্যুর পর বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতা কার্যত রাজা গণেশের হাতে এল। কিন্তু নাম রাজা হলেন অন্য ব্যক্তি। তার নাম শিহাবুদ্দীন বায়েজিদ শাহ। 



আরো পড়ুন :




নূপুর শর্মাকে: কী শাস্তি দিলো ভারতের সুপ্রিম কোর্ট?







     সুলতান শিহাব-উদ-দীন বায়েজিদ শাহ (১৪১১/১২-১৪১৪/১৫) 







প্রভুহন্তা শিহাব-উদ-দীন সুলতান ছিলেন মোট তিন বছরে মত। তার মাদ্রাগুলো পাণ্ডুয়া,সাতগাঁও ও মুয়াজ্জামাবাদের টাকশাল থেকে উৎকীর্ণ হয়েছিল। ''সম্ভবত শিহাবিদ্দুন গণেশের বিরুদ্ধে যাবার চেষ্টা করাতেই গণেশ তাকেই আক্রমণ ও বধ করেছিলেন। ''






সুলতান আলা-উদ-দীন ফিরোজ শাহ (অল্পদিন)







বায়েজীদ শাহর মৃত্যুর পরে কিছুদিনের অবস্থাটা বেশ ঘোলাটে। কোন ইতিহাসে বায়েজীদ শাহর পরবর্তী সুলতানের নাম পাওয়া যায় না। কিন্তু বায়েজীদ শাহর রাজত্বের শেষ বছরে আলা-উদ-দীন ফিরোজ শাহ কর্তৃক উৎকীর্ণ মুদ্রা পাওয়া যায়, যাতে তিনি নিজেকে বায়েজীদ শাহর পুত্র বলে দাবি করেছেন। 



মুদ্রাগুলি উৎকীর্ণ করা হয়েছিল সাতগাঁও ও মুয়াজ্জমাবাদের টাকশাল থেকে, ফিরোজাবাদ বা পাণ্ডুয়ার টাকশাল থেকে নয়। তাই ডক্টর আব্দুল করিম মনে করেন : গণেশ বায়েজীদকে হত্যা করার পর আলা-উদ-দীন ফিরোজ শাহ কোন রকমে ফিরোজাবাদ থেকে পালিয়ে গিয়ে সৈন্যদের সহায়তায় পূর্ব ও দক্ষিণ বঙ্গে স্বীয় কতৃত্ব স্থাপনের চেষ্টা করেন। কিন্তু গণেশ তাকে আক্রমণ করে পরাস্ত করেন। এবার বাংলার মসনদে অধিষ্ঠিত হন গণেশ নিজেই। 






রাজা গণেশ (১৪১৪/১৫-১৪১৬ সাল) 






ঐতিহাসিক সুখময় মুখোপাধ্যায়ের মতে, একক কৃতিত্বের দিক দিয়ে গণেশের সঙ্গে খুব কম লোকের তুলনা চলতে পারে। ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত বাংলা ছিল মুসলমানদের অধিকারে। এর মধ্যে কখনো কোথাও হিন্দুদের প্রাধান্য স্থাপিত হয়েছে বটে, কিন্তু সমগ্র বাংলার সিংহাসন অধিকার করার কৃতিত্ব একমাত্র গণেশেরই। 


 



সুলতান সিকান্দার শাহর সময় থেকেই বাংলার রাজধানীতে আরম্ভ হয় দলীয় কোন্দল। তারই প্রভাবে হয়তো অনিবার্য হয়ে ওঠে গিয়াস-উদ-দীন আজম শাহর সঙ্গে তার পিতা সুলতান সিকান্দারের যুদ্ধ। গিয়াস-উদ-দীন আজম শাহ মসনদ লাভ করেন। সে সময়েই ভাতুড়িয়ার প্রাচীন জমিদার বংশের সন্তান রাজা গণেশ সুলতানের প্রশাসনে উচ্চপদ লাভ করেন এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী হন। 




রাজা গণেশের পরবর্তী কার্যাবলীর রূপরেখা সুলতান গিয়াস-উদ-দীন আজম শাহ, সাইফ-উদ-দীন হামজা শাহ এবং বায়েজীদ শাহ ও তদীয় পুত্র আলা-উদ-দীন ফিরোজ শাহর নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে তুলে ধরা হয়েছে। রাজা গণেশের এই কৃতিত্বের পেছনে যে রাজধানীর আমিরজনদের দলীয় কোন্দল যথেষ্ট কার্যকরী ছিল তা ধারণা করা যায়। অবিশ্যি ক্ষমতা কুক্ষিগত করার পর রাজা গণেশ যখন মুখোশ খুলে ফেলে নিজেই সিংহাসনে বসলেন তখন আমিরজনদের বোধোদয় হয়। কিন্তু গণেশের বিরোধিতা করার ক্ষমতা তখন আর তাদের হাতে আর ছিল না। রাজা গণেশ তখন দনুজমর্দনদেব উপাধি গ্রহণ করে বাংলার সিংহাসনে সুপ্রতিষ্ঠিত। 






কিন্তু নেতৃত্ব আসিল সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে। রাজনীতিতে যাহার কোন আসক্তি ছিল না, যিনি পার্থিব ভোগবিলাসে বিমুখ, সেই জ্ঞানবৃদ্ধ দরবেশ নূর কুতুব আলম যখন দেখিলেন যে, দেশের মুসলমান আমীর- ওমরাহরা হতবল, তখন তিনি পার্শ্ববর্তী স্বাধীন রাজ্য জৌনপুরের সুলতান ইবরাহীম শর্কীকে বাংলাদেশ আক্রমণের আমন্ত্রণ জানালেন। গণেশ কর্তৃক মুসলমানদের উৎপীড়ন বিশেষ করে মুসলমান দরবেশদের উপর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে তিনি রাজনৈতিক বেপারে হস্তক্ষেপ করলেন। ইবরাহীম শর্কী বাংলাদেশ আক্রমণ করেন। 




এই সংবাদ পেয়ে গণেশ ভীত হয়ে পড়েন এবং নিজের ছেলে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করে তার হাতে রাজ্যভার তুলে দিয়ে তিনি নূর কুতব আলমের সঙ্গে সমঝোতা করেফেলেন। রাজনীতিবিদ গণেশ যে চাতুরী করলেন, তা নূর কুতব আলম বুঝতে পারলেন না। যদিও একজন মুসলমান সিংহাসনে অধিষ্ঠিত, সমস্ত ক্ষমতা গণেশের হাতেই এবং মুসলমানদের উপর অত্যাচারও পূর্বের মতো চলছে। 






নূর কুতব-ই-আলমের ইনকালের পর এ সত্য আরোও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। রাজা গণেশ যাদুকে শুদ্ধির মাধ্যমে আবার হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে আনেন এবং তাকে মসনদ থেকে সরিয়ে নিজেই আবার তাতে আরোহন করেন।এবারে প্রায় ১৪মাস রাজত্ব করার পর তিনি নিহত হন। নিহত হন অস্বাভাবিকভাবেই। যদুকে হিন্দু করেই তিনি ক্ষান্ত হন নি। 





তাকে কারারুদ্ধও করে রাখেন এবং যদুও কারাগার থেকে পালিয়ে পিতাকে গোপনে হত্যার ব্যাপারে সমাধা করেন। অবিশ্যি যদু সঙ্গে সঙ্গে সিংহাসনে আরোহন করেননি। কারণ দরবারের ষড়যন্ত্র ততদিন দৃঢ়মূল হয়ে গেছে। কাজেই রাজা গণেশের মৃত্যুর পর বাংলার সিংহাসনে বসেন তার কনিষ্ঠ পুত্র মহেন্দ্রদেব। তবে মহেন্দ্রদেবের রাজত্বকাল ছিল মাস দুয়েকের বেশি নয়। এর মধ্যে যদুসেন আবার ইসলাম ধর্মে ফায়ার আসেন এবং মহেন্দ্রদেবর স্থলে নিজে মসনদে আরোহন করেন। অভিহিত হন জালাল-উদ-দীন মুহম্ম্দ শাহ বলে।   











Post a Comment