ইলিয়াসশাহী রাজবংশ:সুলতান সিকান্দার শাহ (১৩৫৭-১৩৯৩)



ইলিয়াসশাহী রাজবংশ


 পিতার মৃত্যুর পর সিকান্দার শাহ বাংলার মসনদে আরোহন করেন। তিনি ছিলেন পিতার উপযুক্ত পুত্র। তার সুদীর্ঘকালের শাসন তাই প্রমান করে। বাংলার আর কোনো সুলতান বা শাসনকর্তা এত দীর্ঘকাল এদেশ শাসন করেন নি।কিন্তু দুঃখের বিষয়,এই অনন্যসাধারণ সুলতানের বিষয়ে বিশেষ কোনো তথ্যই জানা যায়নি। ইতিহাস গ্রন্থে যা উল্লেখিত আছে তা হচ্ছে দিল্লির সুলতান ফিরোজ শাহ কর্তৃক দ্বিতীয় বারের মতো বাংলায় যুদ্ধাভিযান। এই অভিযানে ফিরোজ শাহ এর বাহিনীতে ছিল ৭০,০০০ ঘোড়সওয়ার ,৪৭০ টি রণহস্তী এবং অনেক নৌকা। এখানে প্রশ্ন জাগতে পারে,সুলতান ইলিয়াস শাহ এর সঙ্গে উপঢৌকন বিনিময়ের পরে পরেই কেন দিল্লির সুলতান বাংলায় যুদ্ধাভিযান পরিচালনা করেন। 

পরবর্তীকালে লেখা ইতিহাস গ্রন্থগুলীতে ফিরোজ শাহ এর এই দ্বিতীয় বঙ্গাভিযান সম্বন্ধে নতুন তথ্য পাওয়া যায়। "তারিখ-ই-মুবারক শাহী তে লেখা আছে যে,৭৫৯ হিজরীর শেষ দিকে বাংলাদেশ থেকে দূতেরা ফিরোজ শাহের দরবারে উপঢৌকন নিয়ে এসেছিলো এবং তার পরেই ফিরোজ শাহ বাংলাদেশে অভিযান করেন। একথা সত্য বলেই মনে হয়। তা হলে বলতে হবে ,ফিরোজ শাহ এর অভিযান এর প্রস্তুতি তার আগেই সম্পন্ন হয়েছিল। কিন্তু ফিরোজ শাহ বাংলার রাজদূতদের কিছুই বুঝতে দেন নি এবং তারা চলে যাবার পরে তিনি বাংলার বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা শুরু করেন।




ইলিয়াসশাহী রাজবংশ



 ফিরোজ শাহ এর প্রথম বঙ্গাভিযানের সাথে দ্বিতীয় বঙ্গাভিযানের তুলনা করলে বোঝা যায় ,দ্বিতীয় বঙ্গাভিযানের সময় তিনি বেশি প্রস্তুত হয়ে এসেছিলেন। প্রথম অভিযানটি "তবকাত-ই-আকবরী'র উক্তি অনুসারে পুরো এক বছরও স্থায়ী হয়নি এবং ফিরোজ শাহ বর্ষা আসার সম্ভাবনা দেখা মাত্র পশ্চাদপসরণ করেছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় অভিযান দু বছর সাত মাস স্থায়ী হয়েছিল।

 এর আসা যাওয়ার সময় বাদ দিলে দেখা যায় ফিরোজ শাহ  প্রায় দু'বছরের মতো সময় বাংলাদেশে ছিলেন। বর্ষাও এবার তাকে নিরস্ত্র করতে পারেনি। কিন্তু তা সত্ত্বেও সিকান্দার শাহ ভেঙে পড়েনি। ইলিয়াস শাহের সঙ্গে ফিরোজ শাহের তবু একবার সম্মুখযুদ্ধ হয়েছিল এবং তাতে ফিরোজ শাহ নামমাত্র জয়লাভ করেছিল। কিন্তু সিকান্দার এই জাতীয় নামমাত্র পরাজয়ও কখনো বরণ করেননি। সুতরাং সিকান্দার শাহ এর কৃতিত্ব ইলিয়াস শাহের চেয়েও বেশি।


ইলিয়াসশাহী রাজবংশ

ফিরোজ শাহের এই দ্বিতীয় বঙ্গাভিযানও সন্ধির মাধ্যমে শেষ হয়েছিল যেখানে বাংলার স্বাধীন সত্তা রক্ষা পেয়েছিলো। 

বাংলার জন্য গৌরবের নিদর্শন এই একডালা দুর্গটি বর্তমান মালদহ জেলার অন্তর্গত প্রাচীন গৌড় নগরীর পাশেই অবস্থিত ছিল। সিকান্দার শাহ সম্পর্কে যেহেতু তথ্যাদির অভাব রয়েছে,তাই তার সম্পর্কে এই বলা যায় যে,তার রাজত্বের প্রথম দিকেই দিল্লির সুলতান ফিরোজ তুগলক বাংলায় আক্রমণ করেন। কিন্তু সুলতান সিকান্দার শাহ বাবার রণনীতি অনুসরণ করে একডালা দুর্গে আশ্রয় নিয়ে দিল্লির আক্রমণ প্রতিহত করেন।


ইলিয়াসশাহী রাজবংশ


দিল্লির প্রথম অভিযান এর মতো এই দ্বিতীয় অভিযান ও ব্যার্থতায় পর্যবসিত হয়। এখানে আবারো উল্লেখ্য যে,"তারিখ-ই-ফিরোজ শাহী 'তে চিত্রিত বাংলার সুলতানের ব্যবহার ও কার্যবলী মোটেও নিরপেক্ষ নয়। দিল্লি কর্তৃপক্ষ দ্বারা প্রভাবিত সেই ইতিহাসে দিল্লির সুলতানকেই ঔজ্জল্যমণ্ডিত করা হয়েছে ,আর কালিমালিপ্ত করা হয়েছে বাংলার সুলতানকে। 

 কিন্তু সুলতান সিকান্দার  শাহ ছিলেন সুনিপুণ ও প্রজারঞ্জক এর শাসনকর্তা। সিকান্দার শাহ ও সুফী দরবেশ কে খুব শ্রদ্ধা-ভক্তি করতেন।শেখ শরফ -উদ-দীন ইয়াহিয়া মানেরীর সঙ্গে সুলতানের ছিল গভীর সৌহার্দ্য। সুফী শেখ আলা -উল-হক এর সাথেও তার হৃদ্যতা ছিল। কিন্তু ক্রমে তাদের মধ্যে জন্ম নেয় মতবিরোধ। কথিত আছে,শেখ আলা -উল-হক তার খানকায় ছাত্র-পথিক ও ভিক্ষুকদের জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় করতেন। তিনি এত অর্থ ব্যয় করতেন যে,সুলতানের পক্ষেও এত ব্যয় করা সম্ভব ছিল না। তাই সুলতান ঈর্ষান্বিত হয়ে শেখ আলা-উল-হককে পাণ্ডুয়া ছেড়ে সোনারগাঁও  -এ চলে যেতে বলেন।তদানুযায়ী শেখ আলা -উল-হক চলে আসেন সোনারগাঁও-এ। আর সোনারগাঁও-এর নব-নির্মিত খানকায় শেখ অর্থ ব্যয়ের পরিমান আরো বাড়িয়ে দেন। 


ইলিয়াসশাহী রাজবংশ


পান্ডুয়ায় আদিনা মসজিদ নির্মান সুলতান সিকান্দার শাহের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি। এই বিরাট মসজিদ নির্মিত হয় ১৩৬৪  সাল থেকে আরম্ভ করে ১৩৭৪ সালের মধ্যে। তার নির্মাণ কাজ শেষ করতে ১০ বছরই লেগেছিলো। মসজিদটি ৫০৭১২ ফুট দীর্ঘ এবং ২৮৫১২ ফুট প্রস্থ

 সুলতান সিকান্দের শাহ এর মৃত্যু হয় এক নাটকীয় ঘটনার মধ্য দিয়ে।সুলতানের প্রথম স্ত্রীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করে সতেরোটি পুত্র এবং দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভে মাত্র একটি,গিয়াস-উদ-দীন। সকল পুত্রের মধ্যে এই গিয়াস-উদ-দীনই  ছিলেন  জ্ঞানে-গুনে শ্রেষ্ঠ এবং পিতার চরম স্নেহভাজন। কিন্তু বিমাতার চক্রান্তে গিয়াস-উদ-দীন রাজধানী গৌড় ছেড়ে গোপনে  চলে আসেন সোনারগাঁও-এ। সোনারগাঁও-এ এসে সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন এবং এগিয়ে যান পিতৃ-সিংহাসন দখল করতে।পিত সিকান্দার শাহও রাজকীয় বাহিনী নিয়ে স্নেহভাজন পুত্রের মুকাবিলা করেন।যুদ্ধ আরম্ভ হয়। সেই যুদ্ধে নিহত হন সুলতান সিকান্দার। খবর পেয়ে বিজয়ী পুত্র ছুটে এসে মুমূর্ষু পিতার মস্তক কোলের উপর রাখলেন। মৃত্যুপথযাত্রী পিতার চোখে যেন পিতার মঙ্গল কামনার দৃষ্টি। পুত্রকে যেন শুভাশীষ জানিয়েই পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন পিত।  


If you visit mwlbd then click the download link.














You have to wait 60 seconds.


Post a Comment