বাংলা সালতানাত : স্বধীনতা প্রয়াসকাল পর্ব :০১


বাংলা সালতানাত : স্বধীনতা প্রয়াসকাল পর্ব :০১






ব্রাহ্মণ শাসন , বৌদ্ধ শাসন অথবা মুসলিম শাসন নির্বিশেষে এই হিমালয়ান উপমহাদেশে কেন্দ্রীয় রাজশক্তি যখনি দুর্বল হয়ে পড়েছে তখনি দেখা গিয়েছে রাজা বা প্রদেশের শাসনকর্তা নিজেদেরকে স্বাধীন শাসক হিসাবে ঘোষণা দিয়েছে। বাংলার শাসন কর্তার পদটির জন্য লুব্ধ আকর্ষণ ছিল অন্যান্য রাজ্য বা প্রদেশের প্রায় সকল শাসনকর্তারই , সকল প্রধান ব্যাক্তিরই। তাছাড়া বাংলার শাসনকর্তাদের মধ্যে দেখা যায় যখনই তিনি সুযোগ পেয়েছেন তখনই তিনি স্বধীনতা ঘোষণা করেছেন এই লাখনৌতি তথা বাংলায়। 




বাংলা সালতানাত : স্বধীনতা প্রয়াসকাল পর্ব :০১




দিল্লি সালতানাতের মধ্যে অন্যান্য রাজ্য বা প্রদেশের চাইতে লাখনৌতির মর্যাদা ছিল সর্বাধিক। দিল্লি থেকে অনেক দূরে অবস্থিত হওয়ায় এবং লাখনৌতির প্ৰাকৃতিক ও ভৌগোলিক অবস্থান দিল্লি বা পার্শবর্তী এলাকাসমূহ থেকে ভিন্ন হওয়ায় কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে লাখনৌতির উপর নিয়মিত কড়া নজর রাখা সম্ভবপর ছিল না। তাছাড়া লাখনৌতির বিদ্রোহ দমন করার উদ্দেশ্য সৈন্যবাহিনী সহ ক্ষিপ্র গতিতে বাংলায় উপস্থিত হওয়া মোটেই সহজ সাধ্য ছিলোনা। 



বাংলা সালতানাত : স্বধীনতা প্রয়াসকাল পর্ব :০১





ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বারনি বলেন যে , বাংলায় আবহাওয়াই ছিল বিদ্রোহীদের পক্ষে সহায়ক। এইখানে শাসকরা স্বভাবতই বিদ্রোহী ছিল। নতুন শাসক আসিলে অমাত্য অনুচর সকলে মিলিয়া তাহাকে বিদ্রোহের প্ররোচনা দিতো। যদি কোনো শাসক বিদ্রোহ করিতে অস্বীকার করিতেন তাহা হইলে অনুচরেরা সকলে মিলিয়া তাহার বিরুদ্ধে করিত। এইসব কারণে দিল্লির লোকেরা বাংলাকে অভিহিত করতো বলগামপুর বা বিদ্রোহী এলাক বলে। 



বাংলা সালতানাত : স্বধীনতা প্রয়াসকাল পর্ব :০১





এর আগে আমরা দেখেছি , দিল্লি কতৃপক্ষের দুর্বলতা বা অসুবিধাজনক অবস্থার সুযোগে লাখনৌতিতে স্বধীনতা ঘোষণা করেছেন চতুর্থ শাসনকর্তা গিয়াসউদ্দিন ইওজ খিলজী এবং পঞ্চদশ শাসনকর্তা মালিক ইখতিয়ার উদ্দিন ইউজবুক। প্রত্যেকেই নিজেদেরকে তারা অভিহিত করেছেন সুলতান বলে। এইসব ঘটনা থেকে বিদ্রোহী বাংলার শাসকদের মেজাজ ও পরিস্তিতি সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায়।



বাংলা সালতানাত : স্বধীনতা প্রয়াসকাল পর্ব :০১





 কিন্তু এই চলমান প্রসঙ্গে আমরা জানব দিল্লিতে বলবনী সুলতানদের শক্তিশালী শাসনামলে ও স্বাধীনতার অগ্নিশিখা জ্বলে উঠেছে বাংলার রাজধানীতে। শুধুমাত্র লাখনৌতির শাসকেরা ও তাদের পাত্রমিররাই নয় , বাংলার স্বধীনতা প্রয়াসে শরিক হয়েছেন বাংলার মানুষেরা ও। বাংলার বুকে জ্বলে উঠেছে স্বধীনতা স্পৃহার  অনিরবান শিখা । দিল্লি কতৃপক্ষের দৃষ্টিতে তা ছিল বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহ দমন করতে বাংলার পানে ধেয়ে এসেছেন লক্ষ লক্ষ সেনা নিয়ে পরাক্রান্ত দিল্লি অধিপতিরা। বিদ্রোহ দমিত হয়েছে প্রাণ দিয়েছেন বিদ্রোহের নেতৃবর্গ , প্রাণ দিয়েছেন অগণিত মানুষ। বাংলায় পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়েছে দিল্লির অধিপত্য। কিন্তু নির্বাপিত হয়নি বাংলার প্রজ্বলিত স্বধীনতা স্পৃহার সেই অনির্বান শিখা। 




বাংলা সালতানাত : স্বধীনতা প্রয়াসকাল পর্ব :০১




বাংলার লাখনৌতি রাজ্যের সঙ্গে যেহেতু দিল্লি সালতানাতের সম্পর্কটাই ছিল প্রধান বিবেচ্য বিষয় , তাই দিল্লি সালতানাতের অবস্থাটা এখানে তুলে ধরা প্রয়োজন মনে করি। 




১২৩৬ সালে সুলতান শামস উদ্দীন ইলতুমিসের মৃত্যুর পর মসনদ নিয়ে আরম্ভ হয় বিশৃঙ্খলা। কুতুব উদ্দিন আইবেক ছিলেন দিল্লির প্রথম স্বাধীন মুসলিম সম্রাজ্যের সূচনা কারী, আর তদীয় জামাতা ইলতুমিস ছিলেন সে সম্রাজ্যের প্রকৃত স্থাপনকর্তা , আইনানুমোদিত প্রথম সুলতান। তিনি ছিলেন ধার্মিক , দয়ালু , দাতা , রণনিপুণ ও সুযোগ্য শাসক।  তার মৃত্যুর পর তার অযোগ্য  পুত্র রুকন উদ্দিন ফিরোজ মাত্র ৬ মাসের জন্য মসনদ অধিকার করেন।



বাংলা সালতানাত : স্বধীনতা প্রয়াসকাল পর্ব :০১






অতঃপর মসনদে আরোহন করেন  ইলতুতমিশের  কন্যা  সুলতানা রাজিয়া।তার শাসনকাল ১২৩৬ থেকে ১২৪০ সাল এরপর সুলতান ইলতুতমিশ  পুত্র মুইজ উদ্দিন বাহরাম শাহ (১২৪০-১২৪২)এবং পরবর্তীতে সুলতান ইলতুতমিশের  অন্য দুই পুত্ৰ সুলতান আলাউদ্দিন মাসুদ শাহ (১২৪২-১২৪৬ সাল )এবং নাসির উদ্দিন মাহমুদ শাহ (১২৪৬-১২৬৬ সাল )।সুলতান নাসির উদ্দিনের রাজত্বকালে প্রকৃত শাসনভার ন্যাস্ত তার শশুর গিয়াস উদ্দিন বলবনের উপর ।






বাংলা সালতানাত : স্বধীনতা প্রয়াসকাল পর্ব :০১



২০. আমিন খান (১২৭২-?)


      
        শের খানের মৃত্যুর পর দিল্লির সুলতান গিয়াস উদ্দিন বলবন  আমিন খান কে লাখনৌতি রাজ্যের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন ।আমিন খান এতদিন ছিলেন অযোধ্যার শাসনকর্তা ।আমিন খানকে সাহায্য করার জন্য সুলতান গিয়াস উদ্দিন বলবন তুগরিলকে বাংলার সহকারী শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন ।লাখনৌতিতে সহকারী শাসনকর্তা নিযুক্ত করার নজির এই প্রথম ।এর দুটি কারণ থাকতে পারে ।প্রথমত, ওই  সময়ে বাংলার এই মুসলিম রাজ্যটির বেশ কিছু বৃস্তিতি ঘটেছিলো ।এর আগে সুলতান ইখতিয়ার উদ্দিন ইউজবুক দক্ষিণ মান্দারন পর্যন্ত সমগ্র রাঢ় এলাকা জয় করেন ।



বাংলা সালতানাত : স্বধীনতা প্রয়াসকাল পর্ব :০১





ইয়ায উদ্দিন বলবন -ই -ইউজবকিও পূর্ব বঙ্গের কিছু অংশ লাখনৌতি রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত করেন ।এই বিস্তৃত লখনৌতি রাজ্যটির সুশাসনের জন্য একজন সহকারী শাসনকর্তা নিয়োগের প্রয়োজন হয়তো সুলতান গিয়াস উদ্দিন বলবন অনুভব করে থাকবেন ।দ্বিতীয়ত ,বিদ্রোহী ভাবাপন্ন বাংলার এই মুসলিম রাজ্যটি তে একজন শাসনকর্তা নিযুক্ত করে সুলতান বলবন হয়তো আশা করেছিলেন যে,একে অন্যের বিদ্রোহাত্মক কাজে বাধা দেবে এবং লাখনৌতির ঘটনাবলী যথাসময়ে দিল্লি সুলতানের গোচরে আনবে ।কিন্তু এই সহকারী শাসনকর্তা তুগরিল সুলতানের সব আশাকে নস্যাৎ করে দেন ।





বাংলা সালতানাত : স্বধীনতা প্রয়াসকাল পর্ব :০১






তিনিঁ আমিন খানের কর্তৃত্ব এড়িয়ে রাজ্যে নিজের আধিপত্য বিস্তারে সচেষ্ট হন এবং অল্প দিনের মধ্যেই তিনি আমিন খান কেন-সুলতান গিয়াস উদ্দিন বলবনের কর্তৃত্বও অস্বীকার করে নিজেকে লাখনৌতির স্বাধীন সুলতান বলে ঘোষণা করেন ।তার উপাধী হয় মুগিস উদ্দিন তুগরিল ।




বাংলা সালতানাত : স্বধীনতা প্রয়াসকাল পর্ব :০১



২১.সুলতান মুগিস উদ্দিন তুগরিল (১২৭২-১২৮২ সাল )


 
     সুলতান তুগরিল বা তুগরল ছিলেন মামলুক বংশীয় এবং লাখনৌতির শাসণকর্তাদের মধ্যে সর্বশেষ্ট ।সহকারী শাসনকর্তা থাকা কালেই তিনি পূর্ব বঙ্গের বিভিন্ন অংশে লাখনৌতির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।১২৭৫ সালে তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করে নিজ নামে খুতবা পাঠ করান এবং মুদ্রা প্রচলন করেন ।তিনি পদ্মা নদীর দুই তীরবর্তী বর্তমান ফরিদপুর ও ঢাকা জেলার বৃস্তিত অঞ্চলের উপর নিজ কর্তৃত্ব স্থাপন করেন ।বর্তমান ঢাকা নগরীর ২৫ মাইল দক্ষিণে এবং রাজবাড়ী থেকে ১০ মাইল দক্ষিণ -পশ্চিমে অবস্থিত দুর্ভেদ্য নারকিলা দুর্গ ছিল তার শক্তির অন্যতম কেন্দ্র ।




কথিত আছে ,রাজ্ বংশের প্রতিষ্ঠাতা রত্না -ফা নিজ ভ্রাতা রাজা -ফা কে বিতাড়িত করার জন্য তুগরিলের সাহায্য প্রার্থনা করেন ।তুগরিল ত্রিপুরা রাজ্যে আক্রমণ  চালিয়ে রত্না -ফা কে সিংহাসন প্রথিষ্ঠিত করেন এবং মানিক উপাধিতে ভূষিত করেন ।বাংলার রাঢ় অঞ্চলে অভিযান চালিয়েও সুলতান তুগরিল জাজনগর দখল করে নিজ রাজ্য সীমার বৃস্তিতি ঘটান ।



বাংলা সালতানাত : স্বধীনতা প্রয়াসকাল পর্ব :০১





  সুলতান মুগিস উদ্দিন তুগরিল ছিলেন সদাশয় একজন শাসনকর্তা এবং বিভিন্ন রাজকীয় গুনের  অধিকারী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী মুক্তহস্ত এক দাতাও ।এইসব গুনের জন্য বাংলার হিন্দু ও মুসলিম সকল মানুষের ভালোবাসাও তিনি পেয়েছিলেন \বলা বাহুল্য ,স্বাধীনতার ঘোষণার পর দিল্লির সুলতান গিয়াস উদ্দিন বলবন তাকে ধ্বংস করার জন্য পরপর দুবার সেনাবাহিনী পাঠান ।





কিন্তু দু বারই সুলতান তুগরিল দিল্লি বাহিনী কে পরাস্থ করেন \অতঃপর সুলতান বলবন নিজেই ৭০ বছর বয়সে প্রায় ৩ লক্ষ্মের বিরাট বাহিনী নিয়ে বাংলার পথে ধেয়ে আসেন ।প্রতিজ্ঞা করেআসেন বিদ্রোহী তুগরিলকে ধ্বংস না করে তিনি দিল্লিতে ফায়ার যাবেন না ।বাংলার বুকে আরম্ভ হয় উভয় পক্ষের মরণপণ সংগ্রাম ।





বাংলা সালতানাত : স্বধীনতা প্রয়াসকাল পর্ব :০১





সুলতান গিয়াস উদ্দিন বলবন অনেক দিনের প্রচেষ্টায় সুলতান তুগরিলকে এক অতর্কিত  আক্রমণে বাগে পেয়ে ধ্বংস করেন ঠিকই ,কিন্তু এজন্য তাকে অনেক মূল্যও দিতে হয়েছিল ।বলবনের লাখনৌতি অভিযানের কাহিনী অনুধাবন করলে দেখা যায় যে ,বাংলাদেশের হিন্দু মুসলিম সকলে মুগিস উদ্দিন এর পক্ষে ছিলেন এবং ইচ্ছে করে কেউ তার সাথে বিস্বাসঘাতকতা করে নাই ।মুগিস উদ্দিন যে দুইবার দিল্লির বাহিনী কে পরাজিত করতে সক্ষম হয় তার মুলে ছিল সৈন্যবাহিনী এবং জনগণের  অকুন্ঠ সমর্থন ।ডক্টর কানুনগোর মতে সুলতান গিয়াস উদ্দিন বলবন শুধু একজন বিদ্রোহী তুগরলের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করেন নাই ,বরং সারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধেই তাহাকে যুদ্ধ করিতে হইয়াছিল ।



You have to wait 60 seconds.











Post a Comment