টেংরিজম বহুঈশ্বরবাদী প্রাচীন জাতিগত ধর্ম
গোক টেংরি
টেংরিজম হল একটি প্রাচীন জাতিগত এবং রাষ্ট্রীয় তুর্ক - মাঙ্গলিক ধর্ম। সাম্রাজ্যিক স্তরে এক ঈশ্বরবাদ ছিল , এই ধর্মের প্রধান আকাশ দেবতা গোক টেংরিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল। এটি ছিল তুর্ক , মঙ্গোল , বুলগেরিয়া , হুন , হাঙ্গারিয়ানদের প্রচলিত ধর্ম। মধ্যযুগীয় বেশ কয়েকটি সম্রাজ্যের রাষ্ট্রীয় ধর্মের মর্যাদা পেয়েছিলো। ভবিষৎবাণী সংক্রান্ত নবম শতাব্দীর পাণ্ডুলিপি ইর্ক বিটিগেতে টেংরীকে তুরুক টাংরিসি (তুর্কিদের ঈশ্বর ) হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
অনেক শিক্ষাবিদদের মতে , টেংরিজম ছিল প্রধানত বহুঈশ্বরবাদ ধর্ম যা এনিমিজমের শামানবাদী ধারণার উপর ভিত্তি করে। বিশেষ করে ১২-১৩ শতকের মধ্যের সম্রাজ্যের সময়কালে টেংরিজম বেশিরভাগ একইশ্বরবাদ ছিল। আব্দুলকাদির ইনান যুক্তি দেন যে , ইয়াকুত ও আলতাই সামানবাদ প্রাচীন তুর্কি ধর্মের সম্পূর্ণ সমান নয়। টেংরিজমের ঈশ্বর গোক টেংরিকে আকাশ ও স্বর্গের দেবতা হিসাবে উপাসনা করে। প্রাচীন মঙ্গোলিয়ানরা মনে করতো চেঙ্গিস খানকে গোক টেংরি স্বর্গে দেবতার স্থান দিয়েছে।
শামানবাদের সাথে টেংরিজমের সম্পর্ক ও পরিভাষা
বিংশ শতাব্দীতে , অনেক বিজ্ঞানী প্রাচীন তুর্কি ও মঙ্গোলীয় রাজ্যে একটি ধর্মীয় সাম্রাজ্যবাদী খাগান সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের প্রস্তাব করেছিলেন। The History of Turkish Holy Tradition বইতে জিয়া গোকাল্প লিখেছেন , যে প্রাচীন তুর্কি রাষ্ট্রগুলোর ধর্ম আদিম শামানবাদ হতে পারে না , যা প্রাচীন ধর্মের একটি জাদুকরী অংশ ছিল।
এই ধর্মে প্রকৃত বিতর্কিত রয়ে গেছে। অনেক পন্ডিতের মতে এটি মূলত বহুঈশ্বরবাদ ছিল , কিন্তু আকাশ দেবতা গোক টেংরীর সাথে একইশ্বরবাদ শাখা একটি রাজবংশীয় বৈধতা হিসেবে বিকশিত হয়েছিল। এটা অন্তত একমত যে টেংরিজম স্থানীয় জনগণের বিভিন্ন লোকধর্ম থেকে গঠিত এবং এর বিভিন্ন শাখা থাকতে পারে।
জীন পল রক্সের মতে , একঈশ্বরবাদী ধারণাটি পরবর্তীতে একটি বহুঈশ্বরবাদী ব্যবস্থা থেকে প্রকাশিত হয়েছে , এটি টেংরিজমের আসল রূপ ছিলোনা। একইশ্বরবাদী ধারণা রাজবংশের শাসনকে বৈধতা দিতে সাহায্য করেছিল। যেহেতু স্বর্গে একমাত্র ঈশ্বর আছেন , তাই পৃথীবিতে শুধুমাত্র একজন শাসক থাকতে পারেন।
অন্যরা উল্লেখ করেছেন যে , টেংরি নিজেই কখনো পরম ছিল না , তবে উচ্চ বিশ্বের অনেক দেবতার মধ্যে শুধুমাত্র একজন , আকাশ দেবতা , বহুঈশ্বরবাদী শামানবাদের যা পরে টেংরিজম নাম পরিচিত হয়।
ঐতিহাসিক টেংরিজম
চীন ইতিহাসে টেংরি নামটা প্রথমবার লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল খিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী থেকে চীন রূপ চিং -লে ব্যবহার করে আকাশ দেবতা হিসাবে। বিভিন্ন তুর্কি ও মোঙ্গলিক লোকধর্ম থেকে টেংরিজম তৈরি হয়েছিল , যেখানে বিভিন্ন সংখক দেবতা ও আত্মা ছিল। তুর্কি লোকধর্মের ভিত্তি ছিল এনিমিজন এবং সাইবেরিয়া। মধ্যে এশিয়া ও উত্তর পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য ধর্মীয় ঐতিহ্যের মতো। পূর্বপুরুষ পূজা টেংরিজমের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। মঙ্গোল সাম্রাজ্যের ধর্মে প্রাথমিক রাষ্ট্রীয় অধ্যাত্বিকতা হিসেবেও টেংরিজম একটি বড় ভূমিকা পালন করেছিল। চেঙ্গিস খান এবং তার অনুসারীদের বেশ কয়েকটি প্রজন্ম টেংরিয়ান বিশ্বাসী এবং শামান রাজা ছিলেন যতক্ষণ না তার পঞ্চম প্রজন্মের বংশধর উজবেগ খান ১৪ শতকে ইসলাম গ্রহণ করেন। পুরোনো টেংরিস্ট প্রার্থনা মোঙ্গলদের গোপন ইতিহাস থেকে আমাদের কাছে এসেছে। যাজক নবী তেমুজিন তাদের বিশ্বাস অনুসারে মহান দেবতা মুনখ টেঙ্গারের কাছে থেকে তাদের গ্রহণ করেছিলেন।
টেংরিস্টরা তাদের অস্তিত্বকে শাশ্বত নীল আকাশ (টেংরি ) , উর্বর মা - পৃথিবীর আত্মা (এজে ) এবং আকাশের পবিত্র আত্মার দ্বারা মনোনীত একজন শাসক হিসাবে টিকিয়ে রাখে বলে মনে করে। স্বর্গ , পৃথিবী , প্রকৃতির আত্মা এবং পূর্বপুরুষরা সমস্ত প্রয়োজনের জন্য সরবরাহ করে এবং সমস্ত মানুষকে রক্ষা করে। একটি ন্যায়পরায়ণ , সম্মানজনক জীবনযাপন করার মাধ্যমে একজন মানুষ তার ভারসাম্য বজিয়ে রাখবে ও তার ব্যাক্তিগত বায়ু ঘোড়া বা আত্মাকে নিখুঁত করবে। উত্তর ককেশাসের হুনরা কথিতভাবে দুটি দেবদেবীতে বিশ্বাস করতো। টেংরি হান যাকে পারস্য ইস্ফান্দিয়ারের অনুরূপ বলে মনে করা হয় , তাদের জন্য ঘোড়া বলি দেয়া হতো।
মঙ্গোলদের গোপন ইতিহাসে টেংরিজম
মাউন্ট বোরখান খালদূন এমন একটি জায়গা যেখানে চেঙ্গিস খান নিয়মিত প্রার্থনা করতেন। ১২৪০ সালে লেখা মঙ্গোলদের গোপন ইতিহাস বহুবার টেংরি হয়েছে। গোপন বইটিতে টেংরি থেকে নিয়তি নিয়ে জন্মগ্রহণকারী বর্তে চিনো যার বাংলা অর্থ নীল নেকড়ে থেকে শুরু করে চেঙ্গিস খানের পূর্বপুরুষদের তালিকা দিয়ে শুরু হয়। টেংরিজম ধর্মের মতে নীল নেকড়ে হলো একটি স্বর্গীয় নেকড়ে। চেঙ্গিস খানের ৯ম প্রজন্মের পূর্বপুরুষ বোধনচর মুনখাগকে টেংরীর ছেলে বলা হয়। তৈমুজিনকে যখন ৯ বছর বয়সে কংগিরাত উপজাতির কাছে স্ত্রী বেছে নেওয়ার জন্য আনা হয়েছিল , তখন ওই উপজাতির প্রধান চেঙ্গিস খানের পিতা ইয়াসুইকে বলেছিলেন যে তিনি একটি সাদা বাজ পাখির স্বপ্ন দেখেছিলেন। তেমুজিনের বয়স যখন ১২ তখন সে পাহাড়ে টেংরীর মুখোমুখি হন।
তাইচিউড তার কাছে এসেছিলো যখন সে তার ভাই বোন এবং মায়ের সাথে প্রান্তরে বসবাস করত। চেঙ্গিস খান তাইচিউডর ভয়ে টেরগুন হাইটসের জঙ্গলে লুকিয়ে ছিল তিন দিন লুকিয়ে থাকার পর চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন , পায়ে হেটে তার ঘোড়াকে যাচ্ছিলেন হটাৎ তিনি লক্ষ করলেন তার ঘোড়ার জীন পরে গেছে। তৈমুজিন (চেঙ্গিস খান ) বললেন : " বুঝতে পারি পেটের চাবুকটা ঢিলা হয়ে যেতে পারে কিন্তু স্তনের চাবুকটা কি ভাবে ঢিলা হতে পারে ? টেংরি কি আমাকে যেতে নিষেধ করছেন ? তিনি আরো তিন রাত অপেক্ষা করলেন তারপর আবার সিদ্ধান্ত নিলেন কিন্তু অনেক বোরো একটি পাথর গুহার মুখ বন্ধ করে দিয়েছে। আবার তিনি বললেন " টেংরি কি আমাকে আবারও নিষেধ করছেন ? ফিরে এসে আরো তিন রাত অপেক্ষা করলেন। অবশেষে ৯ দিন ক্ষুদার্ত থাকার পর ধর্য্য হারিয়ে ফেললেন। অনেক প্রচেষ্টার পর যখন বের হলেন তখন সে দেখতে পেল তাইচিউড তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন এবং তাকে ধরে ফেললেন। তোগরুল পরে জামুখ এবং তৈমুজিনের কাছে মেরকিটদের পরাজয়ের কৃত্বিত "শক্তিশালী টেংরীর করুনা " কে দেন।
(মোঙ্গলদের গোপন বইয়ের ১১৩ অনুচ্ছেদঃ )
Post a Comment