মূর্তিপূজার সূচনা ও বিগ্রহসমূহের বিবরণ 




কিভাবে মূর্তিপূজার সূচনা হল ? | How did idolatry begin?




 
এ কথা সুবিদিত যে সাধারণ লোকের মন ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বাস্তবতার দিকেই আকৃষ্ট হয় এবং ভাবজগতের প্রতি তাদের সহজাত বিরাগ থাকে। যে জ্ঞানী ব্যাক্তিরা ভাবাত্মক বস্তু হৃদয়মঙ্গ করতে পারে প্রত্যেক দেশে ও প্রত্যেক যুগেই তাদের সংখ্যা অল্প হয়ে থাকে। যেহেতু সাধারণ লোকের মন চাক্ষুস দৃষ্টান্তই তৃপ্ত হয় ,সেহেতু ইহুদি ,খিষ্টান ও বিশেষ করে Mainichaean প্রভৃতি ধর্মসম্প্রদায় এর নেতারা তাদের গ্রন্থে ও উপাসনাগৃহে চিত্র ও প্রতিমূর্তি রচনা করে পথভ্রষ্ট হয়েছেন। একটি উদহারণ থেকেই আমার একথার যথেষ্ট প্রমান পাওয়া যাবে। আমাদের নবীর (সঃ ) বা মক্কা মদিনার একটি চিত্র যদি কোনো অশিক্ষিত পুরুষ ও স্ত্রী লোকে দেখানো হয় , তুমি দেখবে যে সে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে চিত্রটিকে চুম্বন করছে ,কপাল স্পর্শ করাচ্ছে তাকে সমুখে রেখে ধুলোয় গড়াগড়ি দিচ্ছে , যেন সে আসল ব্যাক্তি বা পবিত্র গৃহকেই দেখছে এবং  ধারণায় সে যেন সাধারণ ও বিশেষ হজের সমস্ত অনুষ্ঠান পালন করছে। 




প্রতিমা নির্মাণ এই কারণেই হয়ে থাকে। এগুলো আসলে নবী , জ্ঞানী , দেবতা , প্রমুখ শ্রধেয় ব্যাক্তিদের স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে তৈরি করা হয় , যার দ্বারা তাদের অনুপস্থিতিতে বা মৃত্যুর পর তাদের গুনের কথা লোকের  মনে জাগরুক থাকে। সাধারণের অন্তরে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতাটার ভাব অম্লান থাকে। সারকমূর্তি হবার বহুকাল , বহু শতাব্দী কেটে গেলো তার আসল উদ্যেশ্য লোকে ভুলে যায় এবং তাকে অর্চনা করে সম্মান করা প্রথা ও অভ্যাসে পরিনিত হয়ে পরে। পরে সাধারণের এই মনোবৃত্তের সুযোগ নিয়ে শাস্ত্র কারেরা এ অভ্যাস কে বিধানের অন্তর্ভুক্ত করে দেয়। তখন এই মূর্তি ও চিত্রগুলোকে পূজা করা লোকের ধর্মীয় কর্তব্য হয়ে দ্বারায়। মহাপ্লাবনের পূর্ব ও পরের ইতিবৃত্তগুলোতে এ ধরণের কথাই পাওয়া যায় এমনকি এও কথিত আসে ঈশ্বর তার দূত পাঠানোর পূর্ব পর্যন্ত সমস্ত মানুষ জাতি মূর্তি উপাসক ছিল। 



কিভাবে মূর্তিপূজার সূচনা হল ? | How did idolatry begin?







 
Torah গ্রন্থের অনুগামীরা মূর্তিপূজার সূচনা ইব্রাহিমের প্রপিতামহ সারুখের সময়ে হয়েছিল বলে মনে করে। রোমানরা কিন্তু বলে যে Romulus ও Romanus নামক ফ্রাঙ্ক জাতীয় ভাতৃদ্বয় রাজা হয়ে রোম নগরীর পত্তন করে। পরে Romulus তার ভ্রাতাকে হত্যা করে ,যার ফলে দীর্ঘকাল ধরে অন্তবিপ্লব ও যুদ্ধ বিঘ্রোহ চলতে থাকে। অবশেষে Romulus নতি স্বীকার করে এবং স্বপ্ন দেখেন যে তার ভ্রাতা কে সিংহাসনে না বসালে শান্তি প্রতিষ্টা হবেনা। তখন সে তার ভ্রাতার এক স্বর্ণমূর্তি নির্মাণ করে তার পাশে রাখে এবং প্রতিটি ঘোষণার "আমরা (দুই ভাই ) এই আদেশ দিচ্ছি " এই বাক্য ব্যবহার করতো। সেই থেকে রাজাদের বহুবচন ব্যবহার করা রাজাদের অভ্যাস হয়ে গেছে। এরপর বিপ্লব শান্ত হয়। Romulus এক উৎসবের আয়োজন করে তার প্রতি তার ভ্রাতার সমর্থকদের শত্রুতা প্রশমিত করতে চেষ্টা করে। তা ছাড়া চার রঙের চারটি অর্শরোহী মূর্তি রচনা করে সে সূর্যের একটা কৃতিসৌধ নির্মাণ করে সবুজ বর্ণের মূর্তিটি মৃত্তিকার প্রতীক , নীলবর্ণের মূর্তি জলের লাল মূর্তি অগ্নির আর শ্বেত বর্ণের বায়ুর। এই সৌধটি এখন পর্যন্ত রোমে বিদ্যমান আছে। 



romulus_und_remus

                                    Romulus and Remus 1st king of Roman Empire





যেহেতু হিন্ধুদের মূর্তিপূজা আমাদের আলোচনার বিষয় , সেজন্য হাস্যকর মতামতের এখন কিছু বিবরণ দেব। কিন্তু এখন আমি বলে রাখি যে এসব মতামত ওদের অশিক্ষিত লোকেরা পোষণ করে। যারা মুক্তি পথের পথিক কিংবা যারা দর্শন ও ধর্মতত্ত্ব অনুশীলন করে এবং যারা ভাবসাধক , যাকে ওরা "স্যার " বলে একমাত্র সেই মৌলিকতত্ত্বের জ্ঞান যাদের আখাঙ্ক্ষা , তারা ঈশ্বর ছাড়া অন্য কেউ এর উপাসনা করে না , মানুষের নির্মিত মূর্তি উপাসনা করার কথা তারা কখনো চিন্তা ও করেনা। 




এ সমন্দ্বে ওদের যেসব কাহিনী আছে তার একটি এই যা সৌনিক রাজা পরীক্ষিতকে বলেছিলো : পুরাকালে অন্বরিষ  নাম এক রাজা ছিল। সে তার মন মত বিস্তৃত রাজ্য পেয়েছিলো। পরে সে রাজ্য ত্যাগ করে দীর্ঘ কাল ঈশ্বরারাধনায় রত থাকে। অবশেষে দেবরাজ ইন্দ্রের রূপ ধরে হস্তী পৃষ্ঠে ঈশ্বর তার সমুখে আবির্ভুত হয়ে তাকে বর চাইতে বলেন। অন্বরিষ বললেন , 'তোমার দর্শনে আমি তৃপ্ত হয়েছি , তোমার প্রাসাদে আমার এ সৌভাগ্য , সেজন্য আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু আমার প্রার্থনা তোমার কাছে নয় , তোমাকে যে সৃষ্টি করেছে তার কাছে। ইন্দ্র বললেন , ' তপস্যার উদ্দেশ্য সুফল লাভ। অতএব যার নিকট থেকে পুরস্কার পেয়ে এসেছো তার কাছেই তোমার মনোস্কামনা ব্যাক্ত করো। 'তোমার কাছে নয় অন্যের কাছে এমন তর্ক তুলো না। ' 

রাজা বললেন ,' পৃথিবী আমার আয়ত্তে আছে , কিন্তু পৃথিবীর কিছুতেই আমার আসক্তি নাই। আমার সাধনার উদ্দেশ্য ঈশ্বর দর্শন - যা তুমি আমাকে দিতে পারোনা তোমার নিকট আমার ইষ্টসিদ্ধি কেন চাইবো ? 
ইন্দ্র বললেন : ' বিশ্ব ও বিশ্বের সব কিছু আমার বাধ্য। কে তুমি যে আমার বিরুদ্ধ চারণ করছো ?"
রাজা বললেন : " আমি ও তোমার আজ্ঞা শুনি ও পালন করি। কিন্তু আমি তারই আরাধনা করি যার কাছ থেকে তুমি এই প্রভুত্ব লাভ করেছো। তিনি এই বিশ্ব ভ্রমাণ্ডের অধিশ্বর , যিনি তোমাকেও বলি ও হিরণ্যক্ষরাজ্যদ্বয়ের আক্রমণ থেকে রক্ষা করেছিলেন। অতএব আমার অভীষ্টকর্ম করতে দাও ,আমার প্রণাম নিয়ে বিদায় হও। "
ইন্দ্র বললেন : তুমি যখন আমাকে অমান্য করতে কৃতসংকল্প হয়েছো , তোমাকে আমি বধ ও ধ্বংস করব। "



রাজা উত্তরে বলিলেন : " লোকে বলে সুখ ঈর্ষার উদ্রেক করে , দুঃখে করুনা হয়। মরজগৎ থেকে যে মুক্তি পায় দেবতারা তাকে ঈর্ষা করে , সেজন্য তাকে ভ্রষ্ট করতে সচেষ্ট থাকে। যারা সংসার ত্যাগ করে একান্তভাবে ভগবৎ আরাধনায় নিযুক্ত আছে আমি তাদের একজন। যত দিন বাঁচবো আমি এই আরাধনা ত্যাগ করবোনা , আমার এমন কোনো পাপ কর্ম জানিনা যার জন্য আমি তোমার বদ্ধ হতে পারি। যদি বিনা দোষে আমাকে হত্যা করতে চাও , সে তোমার অভিরুচি। কি চাও তুমি ? যদি আমার মন একান্তভাবে নিবিষ্ট থাকে , যদি আমার ভক্তি নির্মল হয় , তা হলে তুমি আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবেনা। যে ঈশ্বর ধ্যানে আমি নিযুক্ত আছি সে ই আমার জন্য যথেষ্ট। সেই ধ্যানই  আবার করবো। "




রাজা পুনরায় ধ্যানস্থ হলে মানব রূপে ঈশ্বর তার সমুখে উপস্থিত হলেন , নীল পদ্মের বর্ণ , গৌরিক বসন , গরুড় নামক পক্ষির পৃষ্টে আসীন , তার এক হাতে শঙ্খ অন্য হাতে চক্র , তৃতীয় হাতে কবচ , আর চতুর্থ হাতে পদ্ম। তাকে দেখে রাজা ভয়ে কম্পিত হলো , ভুলন্টিত হয়ে তার স্তব করতে লাগলো। ভগবান তাকে শান্ত করে তার অভিলাষ পূরণের আশ্বাস দিলেন। 

রাজা তখন বললেন : " আমার রাজ্যের কোনো প্রতিদ্বন্ধি ছিল না , রোগ বা শোকে আমি কখনো পীড়িত হয়নি , সমস্ত পৃথিবী যেন আমারই ছিল , কিন্তু আমি পৃথিবী থেকে বিমুখ হয়েছি , যখন জেনেছি যে পার্থিব সুখের পরিনাম আসলে মন্দ হয়। যা আমি এখন পেয়েছি তাছাড়া আমি কিছু কামনা করিনা। এরপর ভববন্ধন থেকে মুক্তি ছাড়া অন্য কিছু চাইনা। "
ভগবান বললেন : " পৃথিবীকে সযত্নে পরিহার করে নির্জনে বাস করলে নিয়ত ভগবৎচিন্তা ও ইন্দ্রিয় সংযম করলেই তুমি তা পাবে। " 





রাজা বললেন : তুমি না হয় এমন শক্তি আমাকে দিয়েছো যার প্রসাদে আমি তা করতে পারি। কিন্তু অন্য লোক তা কি করে করবে ? অন্য বস্ত্রের প্রয়োজন মানুষের চিরন্তন , এই দুইটি বস্তুই তো তাকে পৃথিবীর সাথে যুক্ত করে রাখে। কেমন করে সে অন্য চিন্তা করবে ?"
ভগবান বললেন : " তোমার রাজ্য ও এবং সংসারকে ন্যায় প্রতিষ্ঠা ও হিত -সাধনে নিযুক্ত রাখো , পৃথিবীর শ্রী সাধন , তার অধিবাসীদের সংরক্ষণ , দান দক্ষিণা প্রভৃতি তোমার প্রত্যেক কর্মই আমাকে চিন্তা করো। যদি স্বাভাবিক মানবীয় বিস্মৃত তোমাকে কখনো আশ্চন্ন করে , তা হলে আমার এই বর্তমান রূপের প্রতি মূর্তি গঠন করো এবং সুগন্ধি পুষ্পাদি দিয়ে তার অর্চনা করো। সে বিগ্রহকে আমার নিদর্শন মনে করো , যাতে আমাকে কখনও বিস্মৃত না হয়। দুঃখে আমাকে স্বরণ করো , বচনে আমার নাম উচরণ করো , কর্ম আমারই উদ্দেশে করো। "






রাজা পুনরায় বলিলেন : " আমার সাধারণ কর্তব্য এখন আমি বুঝেছি। কিন্তু আরো বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে অমিয় অনুগৃহীত করুন। "
ভগবান বললেন : " তা আমি পূর্বেই করেছি , তোমার বিচারাধিকরণ বশিষ্ঠকে প্রয়োজন মতো সবকিছু বোঝার প্রেরণা দিয়েছি। সকল জিজ্ঞাসার উত্তর তার কাছেই পাবে। " 
তার পর সে মূর্তি অন্তর্হিত হলো। রাজা তখন গৃহে গিয়ে আদিষ্ট কর্ম পালনে নিযুক্ত হলেন। 


ভারতীয়রা বলে যে সেই সময় থেকেই প্রতিমা গঠন আরাম্ব হয়েছে। গল্পে বর্ণিত মূর্তির লক্ষণ অনুযায়ী কেউ উপরোক্ত চতুর্ভুজ বিগ্রহ নির্মাণ করেন , কেউবা দ্বিভুজ। 



idolatry





পুরাকালে ইউনানীরা ও বিগ্রহগুলোকে মানুষ ও আদিকারণের মধ্যস্ত শক্তি বলে বিশ্বাস করতো এবং নক্ষত্র ও মহত্তম গুণাবলীর নামে তাদের পূজা করতো , কারণ আদি কারণের সম্মানার্থে তারা অস্তিবাচক বিশেষ্য তাতে আরোপ না করে শুধু নেতিবাচক গুন্ দিয়ে তার বর্ণনা করতো , কেননা তাকে মানবীয় গুনের বহু উর্ধে এবং সর্বদোষ মুক্ত বলে তারা কল্পনা করতো। কাজেই উপাসনায় এই নির্গুনকে কি নাম সম্বধোন করতে পারতো ? 





প্রাচীন আরবের যখন সিরিয়া থেকে বিগ্রহসমূহ দেশে নিয়ে এল , ঈশ্বরের কাছে তাদের জন্য সুপারিশ করবে এই বিশ্বাসে তারা সেগুলোর উপাসনা করতে আরম্ভ করলো। 

প্লেটো তার বিধান গ্রন্থে চতুর্থ অধ্যায়ে বলেছেন : " ঈশ্বরকে যে পূর্ণ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন তার উচিত দেবতা ও শিল্প কাব্যদির অদিষ্ট দেব -দেবীর রহস্যঃ ও বোঝার চেষ্টা করা এবং কোনো নতুন দেবমূর্তিকে পূর্বপুরুষদের দেবতাদের উপরে প্রাধান্য না দেয়া। পিত মাতার জীবৎকালে তাহাদের যথাসাধ্য শ্রদ্ধা নিবেদন করা তার সর্বপ্রধান কর্তব্য। "




এখানে প্লেটো বিশেষ ধরণের ধ্যানের অর্থে 'রহস্য' শব্দ ব্যবহার করেছেন।  এই অর্থে শব্দটি Harran এর U . C . sabian  দৈত্ববাদী U .C  manichacan  ও অস্তিকাব্যদি হিন্দুদের মধ্যে প্রায়ই ব্যবহার হয়। 







Aristotle এর একটি রচনা পাওয়া যায় যাতে তিনি আলেক্সান্ডার প্রেরিত কয়েকজন ব্রাহ্মণের প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন।  তাতে আসে : " তোমরা বলে থাকো যে ইউনানীদের কেউ কেউ মনে করে দেবমূর্তিগুলো কথা বলে এবং তাদিগকে আধ্যাতিক জীব বিশ্বাস করে ইউনানীরা তাদের পূজা করে।  এ সমন্ধে আমরা কিছুই জানিনা , এবং যা জানি না সে সম্বন্ধে মতামত প্রকাশ করা উচিত নয়।" 

এই উক্তিতে অ্যারিস্টট্ল মূর্খ ও ইতরজন শ্ৰেণীর উর্ধে উঠে গেছেন এবং তিনি নিজে যে এসব ব্যাপার নিয়ে ব্যাপৃত থাকেন না তারই ইঙ্গিত দিয়েছেন। 





তা হলে জানা গেল যে মূর্তিপূজা মতো কুসংস্কারের আদি কারণ হলো মৃতের স্মৃতি রক্ষা আর জীবিতদের সান্তনা দেয়া। তারপর। এই কুসংস্কারটি বেড়ে বেড়ে এক সর্বনাশ রোগে পরিণত হয়েছে। 



You have to wait 60 seconds.
















Post a Comment