ঈশ্বর সম্বন্ধে হিন্দুদের বিশ্বাস 

                                Hindus believe in God



ঈশ্বর সম্বন্ধে হিন্দুদের বিশ্বাস


সব জাতির মধ্যৈই জনসাধারণ ও শিক্ষিত লোকদের মধ্যে পার্থক্য থাকে।  কারণ মার্জিত বুদ্ধি লোকের স্বভাব হলো বিচার বিশ্লেশন করা এবং তার দ্বারা মৌলিক নীতি আবিষ্কার করা আর সাধারণ লোক ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর বাইরে যেতে চায় না , উৎপন্ন বিধান নিয়েই সন্তুষ্ট থাকে , খুঁটিয়ে দেখার উৎসাহ পায় না, বিশেষ করে সেসব ব্যাপারে যেখানে মতামত ও উদ্দেশ্য নিয়ে বিরোধ ও সংঘর্ষ বাধে। 



আল্লাহ সম্বন্ধে হিন্দুদের বিশ্বাস এই যে , তিনি এক , চিরন্তন , অনাদি , অনন্ত , স্বাধীন , সর্ব শক্তিমান , সমস্ত জ্ঞানের আকার , চিরঞ্জীবী , প্রাণদাতা , সর্ব নিয়ন্তা , সৃষ্টিপালক তিনি সমস্থ সাদৃশ বা বৈপরীত্যের অতীত , তার শক্তির তুলনাই তিনি ; কিছুই তার মতো নয় , তিনি ও কোনো কিছুর মতো নন। 



ওদের বিশ্বাস সম্মন্ধে আমার এই উক্তিটি যাতে জনশ্রুতি বলে মনে না হয় , সেজন্য এ বিষয়ে ওদের গ্রন্থাদি কিছু উদৃত করবো। 





পাতঞ্জল  গ্রন্থে শিষ্য জিজ্ঞাসা করেছেন : যার উপাসনায় পরমানন্দ লাভ হয় সেই উপাস্য কে ?

গুরু বলেছেন : তিনি সেই আদি ও অদ্বিতীয় পুরুষ যিনি এমন কোনো কর্মের অপেক্ষা রাখেন না যার প্রতিফলস্বরূপ মানুষকে তাঁর পরম কাম্য , শান্তি বা চরম ভীতির আকর , দুঃখ - কষ্ট দিতে পারেন। সমস্ত বৈসাদৃশ ও উপমার অতীত বলে তিনি সমস্ত চিন্তার ও অতীত। চিরন্তন জ্ঞান তার গুন্। জ্ঞান লাভ করার অর্থ , যা অজ্ঞাত ছিল তাকে জানা , কিন্তু ঈস্বরের প্রতি এক মুহূর্তের জন্য ও অজ্ঞতা আরোপ করা যায় না।  




শিষ্য আবার প্রশ্ন করলো : যা বললেন তা ছাড়া তাঁর আর কি কি গুন্ আছে ?

গুরু তার উত্তরে বললেন : স্বয়ং ভুশক্তিতে তিনি সবার উর্ধে ; স্থানকালের প্রয়োজন থেকে তিনি মুক্ত। যাকে সমস্ত বস্তূ একান্তভাবে কামনা করে তিনি সেই পরম কল্যাণ। তিনি ভ্রান্তি ও অজ্ঞানতাবিমুক্ত বিশুদ্ধ জ্ঞান। 





শিষ্য প্রশ্ন করে : তাকে বাক শক্তির অধিকারী মনে করেন কি না ?

গুরু উত্তর দিলেন : যেহেতু তিনি সর্বগুনী , সেহেতু তাহার বাক্যগুণ আছেই। 

শিষ্য আবার প্রশ্ন করে : জ্ঞান আছেই বলেই যদি তিনি সবাক , তা হলে তার এবং জ্ঞানী পন্ডিতদের মধ্যে কি তফাত , যারা তাদের জ্ঞাত তথ্যের সংবাদ বাক্য প্রকাশ করেন ?

গুরুদেব জবাব দেন : তফাত হচ্ছে কালের।  জ্ঞানহীন ও নির্বাক থাকার পর পরবর্তীকালে তাদের সংগৃহিত জ্ঞানের তথ্য পন্ডিতরা অন্যদের কাছে বাক্যে প্রকাশ করেছেন , কাজই তাদের জ্ঞান সংগ্রহ ও কথায় তার প্রকাশ নিদ্দিষ্ট কালের পরিপেক্ষিতেই হয়েছে। যেহেতু ঈশ্বরের সঙ্গে কাল বা সময়ের কোনো যোগ নাই সেহেতু ঈশ্বর চিরকালই সর্বজ্ঞানী ও সবাক। তিনিই ব্রহ্মা ও অন্যান্য আদি পুরুষের সাথে নানা ভাবে কথা বলেছেন। তাদের মধ্যে কাউকে তিনি গ্রন্থ দান করেছেন , তার সঙ্গে যোগস্থাপনের জন্য কাউকে বা তিনি দ্বার উম্মুক্ত করে দিয়েছেন , আবার কাউকে তিনি ধ্যান ও চিন্তার দ্বারা তার আশীর্বাদ লাভ করার প্রেরণা দিয়েছেন। 


প্রশ্নকারী বললো : এ জ্ঞান তার কোথা থেকে আসে ?

উত্তরে গুরুদের বললেন : তার পূর্ব জ্ঞান অনন্ত কাল ধরেই আছে এবং এক মুহূর্তেও তিনি অজ্ঞ নন সেহেতু তিনি জ্ঞান ;- যা তার নাই এমন কোনো জ্ঞান তাকে আহরণ করতে হয় না।  যেমন ব্রহ্মাকে প্রদত্ত বেদে বলা হয়েছে " প্রসংশা ও স্তব করো তার যিনি বেদ মন্ত্র ব্যাক্ত করেছেন এবং যিনি বেদ সৃষ্টির পূর্বেও ছিলেন।  "



প্রশ্নকারী আবার বললেন : যিনি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নন তাকে কেমন করে পূজা করেন ?

উত্তরে বললেন : তার নাম উচ্চারণই তাঁর অনন্যতা সপ্রমাণ করে , যেমন তথ্য থাকলেই তার সংবাদ হতে পারে তেমনই , নামের ধারক থাকলেই তবে নাম থাকতে পারে , যদিচ তিনি ইন্দ্রিয়াতীত ও অপ্রত্যক্ষ। তাকে আত্মাই উপলব্ধি করতে পারে এবং একমাত্র ধ্যান ও চিন্তার দ্বারাই তার গুণাবলীর ধারণা করা যেতে পারে। এই উপলব্ধি ও ধ্যানই তার প্রকৃত উপাসনা , এবং অনবরত উপাসনার দ্বারাই ভূমানন্দ লাভ হয়। 


এই বিখ্যাত পুস্তকে হিন্দুদের কথা যা বলা হয়েছে তা এই। 'ভারত ' গ্রন্থের 'গীতা ' নামক অংশে বাসুদেব ও অর্জুনের কথোপথন আছে : আমিই বিশ্বব্রহ্মান্ড , জন্ম -মৃত্যু বিহীন অনাদি অনন্ত ; আমার কর্মের কোনোই প্রতিফল আমার অনিষ্ট নয় ;সৃষ্ট বস্তুর কোনো বিশেষ শ্রেণীও আমি পক্ষপাতী নই , কোনো বিশেষ শ্রেণীও আমার প্রীতিভাজন নয়। আমার সৃষ্টি সকল জীবকেই তার প্রয়োজন মতো কর্মক্ষমতা দিয়েছি। যে আমাকে এই গুন্ দ্বারা চেনে এবং কর্মফলের লোভ বর্জন করে যে আমার মত হবার সাধনা করে তার বন্ধন শিথিল হয়ে পরমার্থ লাভ ও মুক্তি সহজ হয়। 


দর্শনের সীমা নির্দশক সংজ্ঞা হিসাবে পন্ডিতরা সচারাচর যা বলে থাকেন তার সারমর্ম এই দাঁড়ায় যে , সাধ্যমতো ঐশ্বরিক গুনের নিকটবর্তী হওয়ার নামই দর্শন। 








এই পুস্তকে বাসুদেব আরো বলেছেন : বহু লোক পার্থিব অভাবমোচনের লোভে ভগবানের স্মরণ এ যায়। তাদের অবস্থা বিচার করে দেখলে দেখতে পাবে যে ভগবৎজ্ঞান থেকে তারা বহু দূরে পরে আছে , কারণ ভগবান প্রত্যেকের কাছে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ভাবে প্রত্যক্ষ নন , সেজন্য তারা তাকে জানেনা।  অনেকে আছে যারা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য় বস্তু পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ; আবার এমন অনেকে আছে যারা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য় বস্তুকে অতিক্রম করতে পারলে ও প্রকৃতিক তথ্যের জ্ঞান লাভ করেই ক্ষান্ত হয়। তারা জানেনা যে তার ও উপর আছেন তিনি যার ঔরসে কেউ জন্মাই না , যিনি কারওর ঔরসজাত নন , যার অস্তিত্বে সম্পূর্ণ জ্ঞান আয়ত্ত করতে পারেনি ও যার জ্ঞান সর্বোব্যাপি। 



হিন্দুদের মধ্যে কর্মের সংজ্ঞা নিয়ে মতভেদ আছে।  যারা ঈশ্বরকে বিশ্বসৃষ্টির মূল কারণ বলে মনে করেন তারা সমস্ত কর্মের দায়িত্ব তাঁরই উপর অর্পণ করে থাকে। কেননা কারকের অস্তিত্ব যখন তার থেকে পাওয়া এবং তিনিই যখন সমস্ত কর্মের হেতু তখন কারক তারই কর্মে নিমিত্ত মাত্র। অন্য পক্ষের মতে , কর্মের সম্পর্ক ঈশ্বরের সঙ্গে নয় , তার অধীনস্ত জীবাত্মার সঙ্গে। 



সংখ গ্রন্থে সাধক বলেছেন : কর্মকারক সম্বন্ধে কোনো মতভেদ আছে কি না ?

ঋষি বলেছেন : এক দল বলে আত্মা নিষ্ক্রিয় , আর পদার্থ প্রাণহীন জড়ো। স্বয়ং সম্পূর্ণ ঈশ্বর এই দুইটি বস্তুকে যুক্ত ও বিযুক্ত করেন , কাজই তিনি মূল কারক। এই দুইটির সঞ্চালনক্রিয়া তার কাছ থেকেই আসে , যেমন নির্জীব গতিশক্তিহীন বস্তুকে সজীব শক্তি চালান করে। অন্যরা কিন্তু বলে এ দুটি বস্তূর মধ্যে যোগস্থাপন প্রকৃতিই করে থাকে ; কারণ সেসব বস্তু বৃদ্ধি ও ক্ষয়ের নিয়মাধীন , তাদের স্বভাবই তাই।  আরো একদল বলে , আত্মাই প্রকৃত কারণ বেদে উক্ত হয়েছে যে সমস্ত পুরুষ থেকে উদৃত। আবার আর এক দল বলে কালই আসল কারক কেননা বিশ্বভ্রমান্ড মেষশাবকের ন্যায় কালের শক্ত রজ্জুতে বাঁধা , যার দরুন রজ্জুতে সংকোচন সম্প্রচারণ অনুসারে বিশ্ব ও গতি শীল হয়। 




আল্লাহ সম্বন্ধে ভারতীয়দের এই মত। এদের ভাষায় আল্লাহর নাম ঈশ্বর যিনি পরম দাতা যিনি দান করেন কিন্তু প্রতিগ্রহন করেন না। এদের মতে আল্লাহর ঐক্য হচ্ছে absolute এবং আপাতদৃষ্টিতে অন্যান্য বস্তু ভিন্ন মনে হলেও আসলে তারা একেরই বহুরূপ। ওর আরো মনে করে যে ঈশ্বরের অস্তিত্বই প্রকৃত অস্ত্বিত্ব , কারণ অন্য সবকিছুর অস্তিত্ব তার থেকেই পাওয়া।  তিনি আছেন আর অন্য কিছুই নাই ;এরূপ কল্পনা অসম্ভব নয় , কিন্তু অন্য সবকিছুর অস্তিত্ব আছে আর তার অস্তিত্ব নাই , এরূপ চিন্তা করা অসম্ভব। 








হিন্দুদের চিন্তাশীল লোকদের ছেড়ে যদি আমরা জনসাধারণের কোথায় আসি তা হলে এদের বিশ্বাসরীতির নানা বৈচিত্র দেখতে পাই। তার মধ্যে এমন অনেককিছু আছে যা বিভৎস যেমন প্রায় প্রত্যেক সমাজেই এমনকি মুসলমানদের মধ্যেও কিছুটা পাওয়া যায়। আল্লাহর প্রতি মানবীয় প্রকৃতি ও প্রবৃত্তির আরোপ মানুষের উপর তার যথেচ্ছাচারের বিশ্বাস পোষণ করা , কিংবা ধর্মশাস্ত্রের অন্তর্গত বিষয়ের বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে নিষিদ্ব মনে করা ইত্যাদি নানা প্রকারের কুরিতি ইসলামে ও দেখা যায়। জনসাধারণের জন্য রচিত ধর্মসূত্র গুলো অবশ্য স্পষ্ট ও সরলভাবে লিখিত হওয়া দরকার। তা না হলে জনসাধারণের বিশ্বাসে কিরূপ ভ্রান্তি জন্মাতে পারে তার একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যাচ্ছে। 



You have to wait 60 seconds.






Post a Comment