সিন্ধু সভ্যতা থেকে ইসলাম সভ্যতাই বাংলার প্রবেশ 

                                                                   পর্ব  ০১

বাংলায় ইসলাম ও মুসলিমদের বিজয়ের পটভূমি   পর্ব  ০১ | The background of the victory of Islam and Muslims in Bengal



টালত মোর ঘর নাহি পড় বেশী।
 হাঁড়িত ভাত নাহী নীতি  আবেশী ।।
বেঙ্গ সংসার বডহিল জাআ। 
দুহিল দুধু কি বেন্তে শামঅ ।। (চর্যা : ৩৩)

টিলায় আমার ঘর , প্রতিবেশী নেই।  হাড়িতে ভাত নেই। নিত্যই ক্ষুদির (অতিথি ) । (অথচ আমার ) ব্যাঙের সংসার বেড়েই চলেছে। দোয়ানো দুধ আবার বাটে ঢুকে যাচ্ছে (যে খাদ্য প্রুস্তুত হচ্ছে তাও আবার নিরুদেশ হয়ে যাচ্ছে ) । 



বাল কুমার ছঅ মুণ্ডধারী 

উবাঅহিনা মুঁই এক্কু নারি ।

অহংনিসং খাই বিসং ভিখারি 

গোই ভবিত্তি কিল কা হমারী ।।



আমার বালক পুত্র ছয় মুণ্ডধারী। আমি এক উপায়হীনা নারী।  আমার ভিকারি (স্বামী ) অহর্ণিশ কেবল বিষ খায়। কি গতি হবে আমার। 







সেই বহু প্রাচীনকালে আনুমানিক খিস্টপূর্বে ২৫০০ অব্দ থেকে ১৫০০ অব্দের ব্যাপ্তিতে সিন্দু নদ বিধৌত অঞ্চলে গড়ে উঠেছিল এক উন্নত সভ্যতা নাম তার সিন্ধু সভ্যতা। সিন্ধু অঞ্চলে লারাকান জেলার মোয়েন -জো -দারো , পাঞ্জাবের মন্টোগোমারি জেলার হরপ্পা এবং আরো প্রায় ষাটটি শহরের ধ্বংসবশেষ পাওয়া গেছে সেই সিন্ধু সভ্যতার নিদর্শন। এই সভ্যতা আলোকিত সুবিশাল জনপদের উত্তরে পূর্ব পাঞ্জাবের রুপার থেকে দক্ষিণে আহমেদাবাদের লোথার , আর পশ্চিমে আরব সাগরের তীরে অবস্থিত সুতাকাগেনডোর থেকে পূর্বে রাজস্থানের বিকানির। 





Shindu Civilization








মোহিনজোদারো ও হরপ্পা নগরীর উভয়টি ছিল প্রায় তিন মাইল পরিধি বিশিষ্ট সুপরিকল্পিত ভাবে নির্মিত এবং দুর্গ প্রকারে সুরক্ষিত। তখনকার নগরবাসীরা সংগৃহিত খাদ্য মওজুদ রাখতো আদ্রতা প্রতিরোধক গুদামে। শ্রমিকদের জন্য ছিল শ্রেণিবদ্ধ আবাস গৃহ , পুরোহিতদের জন্য প্রাচীর বেষ্টিত বাসস্থান , রাষ্ট্রীয় প্রধান ও অমাত্যদের দরবার হল। ইষ্টক নির্মিত দোতালা পাকা বাড়ি ছিল অনেক ,ছিল গোসল খানা ,আবর্জনা ও ময়লা পানি নিষ্কাশনের জন্য নর্দমা। রাস্তাগুলি ছিল সোজা আর চওড়ায় দশ গজ পর্যন্ত। 






সিন্ধু সভ্যতাকে ব্রোঞ্চ যুগের সভ্যতা বলাই সমীচীন ; কারণ এ যুগে তামা ও টিনের সংমিশ্রনে তৈরি ব্রোঞ্জের ব্যবহার আরম্ভ হয় ব্যাপকভাবে। সর্ব প্রথম তুলার চাষ হয় এখানেই। এখন থেকেই কাপড় রপ্তানি হতো ইরাকে। দজলা - ফোরাত অঞ্চলে গড়ে উঠেছিল সিন্ধু সওদাগরদের ছোট ছোট উপনিবেশ। সিন্ধু সভ্যতার দেশে গড়ে উঠেছিল সুউন্নত অলংকার শিল্প , স্থাপত্যবিদ , ধাতু শিল্প , কৃষিবিদ্যা আর নানা রকম চারু শিল্প। 






Shindu Civilization







খ্রিস্ট জন্মের প্রায় দেড় হাজার বছর আগে সিন্ধু নদের উপত্যাকায় এবং ভারতে ও রাজস্থানের অনেক জায়গায় যেমন তাম্র - প্রস্তর যুগের সভ্যতা ছিল , বাংলাদেশেও এই অঞ্চলে সেইরূপ সভ্যতা সম্পন্ন মনুষ্য গোষ্ঠী বাস করিত। ইহারা ধান্য চাষ করিত। নানা রকমের এবং নানা ধরণের নকশার চিত্র শোভিত মৃৎপাত্র ব্যাবহার করিত , সম্ভৱ নীলগাই প্রভৃতি পশু শিকার ও শুকর প্রভৃতি পালন করিত। এখানকার সর্ব প্রাচীন অধিবাসীরা প্রস্তর ও তাঁরা ব্যবহার করিত এবং ক্রমে লৌহের সহিত পরিচিত হয়েছিল। ইহার অধিবাসীরা ইটের ও পাথরের ভিত্তির উপর প্রশস্ত গৃহ নির্মাণ করিত। কোনো কোনো বাড়ির দেয়ালগুলি নলখাগড়ার সহিত মাটি মিশিয়ে তৈরি হইতো। প্রাচীন সভ্যতার আবাসস্থাল ক্রিট দ্বীপের সহিত বাংলাদেশের সম্বন্ধ ছিল। অজয় নদের উপত্যাকায় নানা স্থানে মৃৎপাত্রের উপর কতগুলি চিহ্ন পরিলক্ষিত হয়। কেউ কেউ অনুমান করেন যে এগুলি বাংলাদেশের প্রাচীন যুগে প্রচলিত অক্ষর। 





সিন্ধু সভ্যতা






সুতরাং প্রাচীন যুগে অন্তত তিন হাজার বছর অথবা তাহার ও পূর্বে যে বাংলাদেশের এই অঞ্চলে সুসভ্য জাতি বাস করিত ইহা ধরে নেয় যেতে পারে। অনেক লৌকিক , ব্রত , আচার , অনুষ্টান , বিবাহ ক্রিয়ার হলুদ সিন্দুর প্রভৃতি ব্যবহার , নৌকা নির্মাণ ও অন্যান অনেক গ্রাম্য শিল্প এবং ধুতি শাড়ি প্রভৃতি বিশিষ্ট পরিচ্ছদ প্রভৃতি ও এই যুগের সভ্যতার অঙ্গ বলেই মনে হয়। মোটের উপর আর্য জাতির সংস্পর্শে আসিবার পূর্বেই যে বর্তমান বাঙলী জাতির উদ্ভব হয়েছিল এবং তাহারা একটি উচাঙ্গ ও বিশিষ্ট সভ্যতার অধিকারী ছিল , এই সিদ্ধান্ত যুক্তি সঙ্গত বলে গ্রহণ করা যায়। 



প্রথমে সিন্ধু সভ্যতা ও পরে বাঙালি সভ্যতা। ভারতের দুই প্রান্তের এই দুই সভ্যতা ক্রমে ধ্বংসপ্রাপ্ত ও লাঞ্চিত হয় আর্যদের হাতে। পোল্যাঙ্গু থেকে মধ্যে এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে ছিল আর্যদের আদি বাসস্থান। কালক্রমে তারা ছড়িয়ে পরে পৃথিবীর নানা দিকে। আসে ইরানে এবং সেখান থেকে একাংশ ভারত উপমহাদেশে। 






Michael Edwardes , A  History of India , First NEL MENTOR edition 1967 PP 21-22 

বইতে আর্যদের সম্পর্কে বলেছেন :

" পূর্বদিকে আর্যদের অভিযান পরিচালনা করার কারণ ভারতে অবস্থিতির হাজার বছরে তাদের জনসংখ্যা বিপুল বৃদ্ধি পেয়েছে।  গঙ্গার পার্শবর্তী এলাকা সমূহ অধিকার করে তারা সমগ্র উত্তরাপথের মালিক হয়ে বসেন। এখানে তারা প্রতিষ্টা করেন বিভিন্ন রাজ্যের কুরু , পঞ্চল, কাশি , কোশল , সুরসেন , মৎস , মগধ , অঙ্গ , বিদেহ প্রভৃতি। আর্য প্রভুত্বের এই ভূ ভাগের নাম হয় আৰ্য্যাবর্ত। 


আর্যরা ততদিনে নগর সভ্যতার পথে বহুদূর এগিয়ে গেছেন।  যাযাবর জীবন ত্যাগ করে গ্রহণ করেছেন গৃহীর জীবন। গড়ে উঠেছে পারিবারিক এবং সামাজিক জীবন। ব্যবহার করতে আরম্ভ করেছেন সোনা রুপার অলংকর। খাদ্য অভ্যাসে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে মাছ , মাংস , দুধ , ডিম্ , ঘি -মাখন প্রভৃতি এমনকি গোমাংস ও।  সোম - সূরা ও নিত্য - গীত ও শিল্প সাহিত্যের ভক্ত হয়েছেন তারা। জীবিকা নির্বাহের প্রধান উপায় হিসাবে বেছে নিয়েছেন কৃষি , শিল্প , বাণিজ্য ও পশুপালনকে। আর সৃষ্টি করেছেন বর্ণ প্রথার -ব্রাম্মন , ক্ষত্রিয় , বৈশ ও শুদ্র। বিজিত রাজ্য সমূহের সকল অধিবাসীই শুদ্র। সংখ্যাই শুদ্ররাই অনেক বেশি এবং তাদের বৃত্তি নির্ধারিত হলো আর্যদের ব্রাম্মন ক্ষত্রিয় বৈশ বর্ণাদির সেবা করা। অগণিত সেবাদাস নিয়ন্ত্রণ কারী আর্যরা তখন সুউন্নত সভ্যতার অধিকারী। সৃষ্টি করেছেন সংষ্কৃত ভাষার এবং সমৃদ্ধ করেছেন সংস্কৃত সাহিত্য। রচিত হয়েছে বেদ - উপনিষদাদি ধর্মগ্রন্থ। "




" বৈদিক ধর্মোবলম্বী আর্যগণ যখন পঞ্চনদে বসতি স্থাপন করেন তখন তাহারা বহুদিন পরেও বাংলাদেশের সহিত তাহাদের কোনো ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিলোনা। ঐতরেয় অরণ্যকে বঙ্গদেশের লোকের নিন্দা সূচক উল্ল্যেখ আছে। বৈদিক যুগের শেষ ভাগে রচিত বোধায়ন ধর্মসুত্রে ও পুন্ড ও বঙ্গদেশ বৈদিক স্বল্পকালের জন্য বাশ করিলে ও আর্যগণের প্রায়শ্চিত্ত করিতে হইবে , এরূপ বিধান আছে ।"




সিন্ধু সভ্যতা থেকে ইসলাম সভ্যতাই বাংলার প্রবেশ |  পর্ব  ০১ | The background of the victory Muslims in Bengal






এই সমুদয় উক্তি হইতে স্পষ্টই প্রমাণিত হয় ,বাংলার আদিম অধিবাসীগণ আর্য জাতির বংশোদ্ভূত নহে। বাংলাদেশে কোলে , শবর, পুলিন্দ, হাড়ি , ডোম , চণ্ডাল প্রভৃতি যে সমুদয় অন্ত্যজ জাতি দেখা যায় ইহারাই বাংলার আদিম অধিবাসীগণের বংশধর। এই মানব গোষ্ঠীকে অস্ত্রো এশিয়াটিক অথবা অস্টিক এই সংজ্ঞা দেওয়া হইয়াছে। কিন্তু কেহ কেহ ইহাদিগকে নিষাদ জাতি এই আখ্যা দিয়েছেন। বাংলার নিষাদ জাতি প্রধানত কৃষি কাজ করে জীবন ধারণ করিত এবং গ্রামে বাস করিত। আর্য জাতির সংস্পর্শে আসিবার পূর্বেই যে বর্তমান বাঙালী জাতির উদ্ভব হয়েছিল এবং তাহারা একটি উচাঙ্গ ও বিশিষ্ট সভ্যতার অধিকারী ছিল এই সিদ্ধান্ত যুক্তিযুক্ত বলিয়া গ্রহণ করা যায়। 




আর্যগণ পূর্বদিকে অভিযানে বেরিয়ে এই বাংলাদেশে ও আক্রমণ করতে আসেন। কিন্তু ব্যার্থ মনোরথ হয়েই তাদের ফিরে যেতে হয়। প্রায় সমস্ত উত্তর ভারত যখন বিজয়ী আর্যজাতির অধীনতা স্বীকার করিয়াছিলেন। বঙ্গবাসীরা তখন সগর্বে মস্তক উত্তোলন করিয়া তাহাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। শতপথ ব্রাক্ষ্মণ বলেন আর্যদের হোমাগ্নি স্বরসতী তীর হইতে সদানীরা (করতোয়া ) নদীর পশ্চিম তীর পর্যন্ত আসিয়া নিভিয়া গিয়েছিলো অর্থৎ সদানীরার ওপর পারে অবস্থিত বঙ্গদেশের মধ্যে তাহারা প্রবেশ করিতে পারেন নাই। তখন তাহারা অপ্রাপ্য আঙ্গুর ফল মাত্রই টক এই নীতি অনুসারে বঙ্গবাসীদের উপরে গালি বর্ষণ করিয়া গাত্রোজ্বলা নিবারণ করিয়াছিলেন। ওতরেও আরণ্যক বলেন বঙ্গবাসীরা অবোধ্য ভাষা ভাষী পক্ষী জাতীয় এবং তাহার ভাষ্যকার তাহার উপর আর এক গ্রাম সুর চড়িয়া তাহাদিগকে পিচাশ , রাক্ষস , অসুর প্রভৃতি মধুর বিভূতি করিয়াছেন। স্বয়ং মনু পর্যন্ত বিধান দিয়েছেন তীর্থযাত্রা ভিন্ন এ দেশে আসিলে প্রায়চিত্ত করিতে হইবে। বাঙালি বণিকেরা দেশ বিদেশ ঘুরিয়া বেড়াইতেন বলিয়া বোধ হয় সমুদ্র যাত্রা বিরোধী আর্যগণ তাহাদিগকে পক্ষী জাতীয় বলিয়া উপহাস করিয়াছিলেন। ভারতীয় আর্যগণ সমুদ্র যাত্রায় অনভ্যাস্ত ছিলেন সুতরাং অজানা সমুদ্রে পারি দেয়া অমানুষিক কার্য বলিয়া মনে করা তাহাদের পক্ষে স্বাভাবিক ছিল। 




অতএব ইহা নিশ্চিতভাবে বলা যাইতে পারে যে বাংলাদেশ আর্যাবর্তের অন্তর্ভুক্ত হইবার পূর্বে বহু সহস্র বছর ধরিয়া তাহারা শিল্প কলা ও কাব্যদি স্বাধীন ভাবে নিজ পুরাতন ভিত্তির উপর গড়িয়া উঠেছিল।  






সিন্ধু সভ্যতা থেকে ইসলাম সভ্যতাই বাংলার প্রবেশ |  পর্ব  ০২

                                     অসমাপ্ত 

You have to wait 60 seconds.














Post a Comment