বর্ণবাদের শিকার এক অস্ট্রেলীয় প্রজন্ম


বর্ণবাদের শিকার এক অস্ট্রেলীয় প্রজন্ম


 আজকের দিনে অস্ট্রেলিয়া পৃথিবীর অনেক মানুষের কাছেই স্বপ্নের স্থান। বিশ্বের অনেক দেশ থেকে অসংখ্য তরুণ উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমান তাসমানিয়ান সাগরের  তীরবর্তী এই দেশে, কারণ অস্ট্রেলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ক্রমাগতভাবে বিশ্ব রেংকিংয়ে ভালো করে আসছে।প্রকৃত সৌন্দর্য যদি বিবেচনা করা হয়,তাহলে অস্ট্রেলিয়া পৃথিবীর সৌন্দর্যমন্ডিত দেশ থেকে একটি। দেশটিতে প্রতিবছর অসংখ্য পর্যটকের আগমন ঘটে। খেলাধুলাতেও আছে ঈর্ষণীয় সাফল্য। অস্ট্রেলিয়ান গ্রীস্মের দেশটিতে এত গরম অনুভব হয় যে টিকে থাকায় কঠিন হয়ে পরে। চারিপাশে সমুদ্র দেশটিতেএত বেশি  সমুদ্র সৈকত রয়েছে যে, প্রতিদিন একটি করে সমুদ্র সৈকত ভ্রমণ  করলেও নাকি কয়েক বছর লেগে যাবে! 


আজকের দিনে সব দিকে এগিয়ে যাওয়া অস্ট্রেলিয়া একটি উন্নত দেশ। কিন্তু আজকে অস্ট্রেলিয়া উৎকর্ষতা দিয়ে যদি দেশটির অতীত যদি বিবেচনা করা হয়, তাহলে মস্ত বড় ভুল হবে।গত শতাব্দীর একটা বড় সময় জুড়ে অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন প্রদেশে প্রশাসকরা এমন বর্ণবাদি আইন প্রনয়ন করেছিলেন, যে গুলো শুনলে চোখে কপালে উঠে যাবে।রাষ্ট্রীয়ভাবে এমন বর্ণবাদি নীতি গ্রহণ করার  পরও তৎকালীন  অস্ট্রেলিয়াকে 'সভ্য' বলা যাবে কিনা,এটি একটি বড় প্রশ্ন  হতে পারে।


বর্ণবাদের শিকার এক অস্ট্রেলীয় প্রজন্ম


অস্ট্রেলিয়া আয়তনের দিক থেকে বেশ বড় একটি দেশ। সাধারণ আয়তনের দেশগুলোতে শহর থেকে দূরবর্তী অঞ্চলগুলোতে আদিবাসী ও নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী বসবাস করে থাকেন।তাদের নিজস্ব  সংস্কৃত,  ভাষ,  ধর্ম ও লোকাচার থাকে।আমরা শহরাঞ্চলে  গতানুগতিক যে অবকাঠামোগত ও জীবন মানের উন্নয়ন দেখে থাকি, আদিবাসী অঞ্চলগুলোতে এসব দেখা যায় না। শহরে আদিবাসীরা পার করে দেয় তাদের পুরো জীবন 'উন্নয়নের' এর জন্য, জীবনকে কিভাবে আরেকটু উন্নত করা যায়, এই চিন্তা তাদের মাথায় সারাদিন ঘুরপাক খায়। উল্টোদিকে আদিবাসী ও নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর সহজ সরল মানুষেরা বছরের পর বছর ধরে এই ভাবে জীবনযাপন করার পরও তাদের কোনো খেদ নেই, কোন অভিযোগ নেই; তাদের যা আছে তারা তাতেই খুশি। অস্ট্রেলিয়া যেহেতু আয়তনে অনেক বড়, তাই সেখানে অসংখ্য আদিবাসী বসবাস করত, তারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম একই ভাবে জীবনযাপন করতো শহরের নীতিনির্ধারকদের চোখে তাদের এই   কোন 'অনুন্নত' জীবন আর সহ্য হচ্ছিলো না, তাই তারা এমন এক নীতি প্রণয়ন কর,  যে নীতির মূল উদ্দেশ্য ছিল আদিবাসীদের সন্তানদের অস্ট্রেলিয়ার মূলধারার  শ্বেতাঙ্গদের সাথে মিলিয়ে ফেলা, আদিবাসীদের বিলুপ্তির হাতে নিয়ে যাওয়া।




   আদিবাসীদের প্রতি এমন দৃষ্টিভঙ্গির পিছনে  যে বিশেষ কারণটি ছিল,সেটি হলো বর্ণবাদ। অস্ট্রেলিয়ান মূলধারার  শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় আদিবাসীরা পিছিয়ে আছে, এটা মেনে নিতে পারছিল না শ্বেতাঙ্গ প্রশাসকরা। তারা চেয়েছিল আদিবাসীদের যেভাবেই হোক অস্ট্রেলিয়ার মূলধারার  শ্বেতাঙ্গ জনসমাজের সাথে মিশিয়ে ফেলতে হবে,তাতে তাদের উন্নয়ন হবে।জন্য অস্ট্রেলিয়ার প্রশাসনরা 'পলিসি অফ অ্যাসিমিলেশন 'হাতে নেন। এই নীতি বাস্তবায়নের জন্য আদিবাসী পরিবারগুলোর শিশুদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে শহরে আনা হয়। শিশুরা ছিল এই নীতির মূল লক্ষ্য, যেহেতু ধারণা করা হতো -তাদের ছোট থেকে শ্বেতাঙ্গ সমাজের সাথে ঠিক মত বেড়ে উঠলে তারা এই নতুন সমাজের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে।কিন্তু এই নীতির কারণে যে আদিবাসী সমাজে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে,এটা কখনোই নীতিনির্ধারকদের ধর্তব্যের মধ্যে ছিল না।'পলিসি অফ অ্যাসিমিলেশন ' শুরু হয় ১৯১০ সালে দিকে, যেটি ১৯৭০ এর দশক পর্যন্ত অব্যহত ছিল।


আদিবাসী শিশুদের মূলধারাসর সমাজের সাথে যুক্ত করার জন্য বিভিন্ন সরকারি আবাসে রাখা হয়,কিছু সংখ্যক বাচ্চা বিভিন্ন দম্পতি দত্তক হিসেবে গ্রহন করে। ছোট শিশুদের পর্যাপ্ত শিক্ষাব্যবস্থা দেওয়া হয়নি,বরং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে যে -আদিবাসী শিশুদের ভাড়া বাড়িতে কাজে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। তাদের জন্য আদিবাসী ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়, তাদের পরিবারের দেয়া নাম পরিবর্তন করে দেওয়া হয়। আদিবাসী শিশুরা হঠাৎ করে শহরে নতুন সমাজে এসে মানিয়ে নিতে না পেরে অস্বস্তি বোধ করে,কিন্তু সে সবের পরে কোনো কর্ণপাত করা হতো না। আদিবাসী শিশুদের সমাজের পবিত্র হিসেবে ধরা হতো,কিন্তু মূল ধারার সমাজে তাদের বড় হতে হয়েছে ক্রমাগত অবহেলা ও বর্ণবৈষম্য মধ্য দিয়ে।শহরের আদিবাসীরা প্রায়ই এই শিশুদের  নির্মম  নির্যাতন করতো।





 এছাড়াও, যেসব সরকারি প্রতিষ্ঠানে তাদের রাখা হয়েছিল,সেখানকার কর্মকর্তা - কর্মচারীরা একটু ভালো ব্যবহার করত না শিশুদের উপর। নিদারুণ মানসিক ও শারীরিক কষ্টের মধ্যে দিয়ে বেড়ে উঠছে প্রতিটি শিশু।আদিবাসী যেসব পরিবার থেকে জোরপূর্বক শিশু নিয়ে আসা হতো,তাদের বিভিন্ন সংকটের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। আদিবাসী সমাজে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্ম একটি সাংস্কৃতিক জ্ঞান,লোকাচার ইত্যাদি প্রবাহিত হয়।ফলে পুরো একটি প্রজন্মের সমস্ত শিশুকে সমাজ থেকে নিয়ে এই আসায় এই জ্ঞানের প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। আদিবাসী সমাজে অসংখ্য সংস্কৃতি ও লোকচার বিলুপ্ত হয়ে যায়।এ ছাড়াও অসংখ্য পরিবার তাদের সন্তান হারিয়ে শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়ে, অনেক সন্তানের হারানোর হতাশায় মেটাতে মাদকের আশ্রয় নেই। এছাড়াও আদিবাসী সমাজে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা কমে যাওয়ার পর নতুন কাউকে পাওয়া যাচ্ছিল না, যেহেতু নতুন প্রজন্মকে আগেই শহর তুলে নেয়া হয়েছিল। অসংখ্য বাবা-মা তাদের কাজের সহযোগী হিসেবে ছোট্ট বাচ্চাদের নিয়ে যেতে,  নতুন নীতির কারণে সেটা বন্ধ হয়ে যায়।  ফলে আদিবাসী সমাজে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে এক ধরনের স্থবিরতা নেমে আসে। 



এইযে আদিবাসী সমাজের বেশ কয়েকটা প্রজন্ম প্রায় সব শিশুকে শহরে ধরে নিয়েছে শ্বেতাঙ্গ সমাজের সাথে মিলিয়ে নেওয়া হয়েছে,সেসব প্রজন্মকে একত্রে বলা 'দ্যা স্টোলেন  এন্ড জেনারেশন '।এই প্রজন্মের শৈশব আসলে চুরি করে নিয়ে গিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়া তৎকালীন সরকার।কিন্তু বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ান সরকার তা বুঝতে পেরেছেন।


You have to wait 60 seconds.








Post a Comment